এক বৈজ্ঞানিক সেমিনারে বিশেষজ্ঞ বক্তারা ‘ব্রেইন ডেথ’ ব্যক্তির শরীর থেকে সংগৃহীত কিডনী এই রোগে আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপনের বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
আজ মিরপুরে কিডনী ফাউন্ডেশনের ১৭তম বাৎসরিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলন অনুষ্ঠানে বক্তারা এবিষয়ে গুরুত্বারোপ করে বক্তৃতা দেন।
কিডনী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা.হারুন আর রশিদের সভাপতিত্বে সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর।
বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিক এসোসিয়েশনের সভাপতি ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সাইন্সের বোর্ড অব ট্রাষ্টি’র চেয়ারম্যান জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ। অনুষ্ঠানে ভার্চূয়ালি যুক্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো: শরফুদ্দিন আহম্মেদ।
সেমিনারে বিশেষজ্ঞ বক্তারা বলেন, উন্নত বিশ্বে এই ধরনের ব্যক্তির শরীর থেকে কিডনী সংগ্রহ করে তা প্রতিস্থাপন করার প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে বহু রোগী কিডনী জটিলতায় মারা যান। অথচ এইভাবে কিডনী সংগ্রহ করা হলে অসুস্থ রোগীরা সুস্থ জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখতে পারেন। এই বিষয়ে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে হবে। এজন্য সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা সৃষ্টির বিকল্প নেই বলেও বক্তারা মনে করেন।
প্রধান অতিথি আসাদুজ্জামান নূর বলেন, বাংলাদেশে কিডনী রোগ ও কিডনী অকেজো রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুটো কিডনী অকেজো হয়ে গেলে রোগীকে বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালেসিস অথবা কিডনী সংযোজন করতে হয়।
তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশে এ দুটো চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে, এই চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আশার কথা এই যে, দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কিছু অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, যেমন- কিডনী ফাউন্ডেশন হাসপাতাল এই রোগীদের ডায়ালেসিস ও কিডনী সংযোজনের ক্ষেত্রে বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে স্বল্পমূল্যে মানুষের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এথেকে অনুপ্রাণিত হয়ে জনস্বার্থে আরো অনেক প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসার আহবানও জানান তিনি।
এ কে আজাদ বলেন, কিডনী রোগের প্রধান কারণ হচ্ছে ডায়াবেটিক এবং উচ্চ রক্তচাপ। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক এসোসিয়েশন গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের সকল ধরনের মানুষের সেবা দিয়ে আসছে। প্রায় ৬০ টি শাখার মাধ্যমে এ সেবা বিস্তৃত করছে। কিডনী ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ডায়াবেটিক ও উচ্চরক্তচাপ থেকে যে সমস্ত রোগীর কিডনী অকেজো হয়ে যাচ্ছে তাদের চিকিৎসার ব্যাপারে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখছে।
অধ্যাপক ডা.হারুন আর রশিদ কিডনী রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে বলেন, মানুষের শরীরে কিডনী রোগ সহজে ধরা পড়ে না। এটি নীরবে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধতে থাকে। কিডনী রোগে আক্রান্ত হওয়ার দীর্ঘদিন পর একজন ব্যক্তি সেই রোগের উপসর্গ সম্পর্কে বুঝতে পারেন, সুতরাং এ জন্য মানুষের সচেতন হতে হবে। ৪০ বছরের পর খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনাসহ বছরে একবার মূত্র ও রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে কিডনীর অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে।
তিনি বলেন, কী কী কারণে কিডনী অকেজো হয় সে সম্পর্কে অজ্ঞতা কমিয়ে জনসচেতনতাও বাড়াতে হবে। পাশাপাশি কিডনী রোগের জটিলতা নিয়ে যে কুসংস্কার রয়েছে তা দূর করতেও ধারণা রাখার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি আরো বলেন, বিশ্বে ৮৫ কোটি মানুষ কোন না কোন ভাবে কিডনী রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে এর সংখ্যা ২ কোটির কাছাকাছি। বিশ্বে কিডনী রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর ৮ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করে এবং আরো ৩ লাখের বেশি মানুষের কিডনী রোগের কার্যকারিতা কমে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি জানান, বাংলাদেশে যে ২ কোটি কিডনী রোগী আছে, তাদের মধ্যে ৪০ হাজার রোগীর প্রতি বছর কিডনী বিকল হয় এবং এদের ৮০ ভাগই মৃত্যুবরণ করে থাকে ডায়ালেসিস অথবা কিডনী সংযোজন এর চিকিৎসার অভাবে। সুতরাং,এই রোগীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য জেলা পর্যায়ে ডায়ালেসিস এবং প্রতিটি মেডিকেল কলেজে কিডনী সংযোজনের ব্যবস্থা রাখা দরকার বলে মতামত দেন তিনি। এর সঙ্গে সঙ্গে কিডনী রোগ বিশেষজ্ঞ, ট্রান্সপ্ল্যান্ট রোগ বিশেষ্জ্ঞ ও নার্সদের উচ্চতর ট্রেনিং বিশেষভাবে প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করেন অদ্যাপক হারুন আর রশিদ।
কিডনী ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অধ্যাপক মুহিবুর রহমান বলেন,বর্তমানে ৩’শ বেডের এই কিডনী ফাউন্ডেশনে প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০ রোগী কম খরচে ডায়ালেসিস করে থাকে। এরমধ্যে ৫৪০ জনের বেশি কিডনী সংযোজন সাফল্যজনক ভাবে করা হয়েছে এবং ৫৫০ জনের মতো রোগী নিজের বাসায় ডায়ালেসিস (সি.এ.পিট.ডি) করে থাকে। এছাড়াও এই হাসপাতালে একটি আধুনিক ল্যাবরেটরী রয়েছে। যেখানে ৩০ শতাংশ কম খরচে সবধরনের পরীক্ষা করা যায়। এছাড়াও প্রতিদিন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মাত্র ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় রোগী দেখে থাকেন। এখানে ৩০ ভাগ রোগী বিনা বেড ভাড়ায় ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতে পারেন।
অধ্যাপক ডা.শরফুদ্দীন আহম্মেদ বলেন,আমাদের দেশে সংক্রামক ব্যাধির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে এবং অসংক্রামিত রোগ দিন দিন বাড়ছে। এই ব্যাধিগুলোর মধ্যে কিডনী রোগ অন্যতম।
তিনি বলেন, কোভিড-১৯ এর সময়ে বিএসএমএমইউ’য়ে কোভিড রোগীর চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এর কারণে আমাদের ডায়ালেসিস ও কিডনী সংযোজনের ক্ষেত্রে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে। বর্তমানে এই সময়ে যখন করোনা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে এসেছে তখন মরণোত্তর কিডনী সংযোজনের ব্যবস্থা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
এই সম্মেলনে দেশ এবং বিদেশের খ্যাতিমান কিডনী ও ট্রান্সপ্ল্যান্ট বিশেষজ্ঞরা অংশ গ্রহণ করেছেন।
বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে দেশী ও বিদেশী চিকিৎসকরা কিডনী রোগের বিভিন্ন দিক, ডায়াবেটিস রোগীর চিকিৎসা ও জনসচেতনতা বিষয়ে আলোচনা করেন।