- প্রকাশিত : ২০১৮-০৪-২১
- ৭৭৫ বার পঠিত
-
নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিনিধি:- ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সেবার মানে উন্নতি দৃশ্যমান। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর দালালদের চৌরাত্ম কমার পাশাপাশি আরও মানবিক হয়েছে চিকিৎসকদের আচরণ। এতে খুশি রোগীরাও। কিন্তু নাখোশ হওয়ার মানুষেরও অভাব নেই। তারা লেগেছে এই পরিবর্তনে যার অবদান নেই হাসপাতাল পরিচালকের পেছনে।
পরিচালক নাসির উদ্দিন আহমদকে হাসপাতাল থেকে বদলি করার চেষ্টা একবার ময়মনসিংহবাসী ঠেকিয়েছে আন্দোলন করে। আবারও পরিচালককে বদলি করে দেয়ার চেষ্টা চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালটির একজন কর্মকর্তা বলেন, স্থানীয় যুবলীগ নেতা এ এই এম ফারুক (টুপি ফারুক নামে পরিচিত) পরিচালককে এখান থেকে সরাতে উঠেপড়ে লেগেছেন। তার ভাই সরকারপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপের নেতা। তার প্রভাব খাটিয়ে হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করতেন ফারুক। ডাক্তার বদলি, ক্যান্টিন পরিচালনা, মাস্টার রোলে কর্মচারী নিয়োগ বা মালামাল ক্রয়ে প্রভাব বিস্তার করতেন এই যুবলীগ নেতা। কিন্তু পরিচালক এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় স্বার্থের আঘাত লাগায় উঠেপড়ে লেগেছেন ওই যুবলীগ নেতা।
নাসির উদ্দিন আহমদ হাসপাতালের পরিচালক হয়ে আসেন ২০১৫ সালে। এর পর কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি হাসপাতালের চেহারাই পাল্টে ফেলেন।
হাসপাতালের অফিস সহায়ক একরামুল হক বলেন, ১৯৬২ সালের পর হাসপাতালের এই রকম পরিচালক কাউকেই পাওয়া যায়নি। তিনি এই হাসপাতালের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করছেন। কিন্তু কিছু কুচক্রী মহল এখনও ষড়যন্ত্র করছে।’
পেশায় ব্যবসায়ী মজিবুর রহমান নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, ‘বর্তমান পরিচালক আসার আগে এই হাসপাতালটিতে কিছু ছিল না। রোগীদের অনেক পরীক্ষা-এক্সরে, আল্ট্রা, এমআরআইসহ গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করার জন্য বাইরের ক্লিনিকগুলোতে যেতে হতো। কিন্তু বর্তমান পরিচালক হাসপাতালে আসার পর ছয় মাসের মধ্যে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করেছেন। এখন আর রোগীদের বাইরের ক্লিনিকগুলোতে যেতে হয় না।’
তবে রোগীদের ভালো আবার ভালো লাগছে না স্বার্থবাদীদের। হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, হাসপাতালে চিকিৎসক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা একধরনের ভয়ে থাকেন যুবলীগ নেতা ফারুকের কারণে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, ‘কী আর বলব। তিনি চিকিৎসক না হয়েও চিকিৎসকদের উপর মাতুব্ববি করেন। পরিচালক স্যার যাদের ওপর নির্ভর করে এই কাজগুলো করেছেন তাদেরকে বদলি করে দেয়ার হুমকি দেয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তাদের কথা মেনে চলতে হবে, নইলে আমরা তো বটেই, পরিচালকও পদে থাকতে পারবেন না।’
পরিচালকের বিরুদ্ধে যুবলীগ নেতার সঙ্গে একাট্টা আশেপাশের বেসরকারি হাসপাতালের মালিক-কর্মচারীরাও। তারা আগে এই হাসপাতালের রোগী ভাগিয়ে নিতেন বা হাসপাতালে রোগ পরীক্ষা না হওয়ার সুফল পেতেন। সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ক্ষেপেছেন তারা।
চতুর্থ শ্রেণি কর্মচারী সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘হাসপাতালের বর্তমান পরিচালক দায়িত্ব নেয়ার পর এর চেহারাই তিনি পাল্টে দিয়েছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে একটি মহল সবসময়ই চক্রান্ত করেছে। গত বছর আগস্টে তাকে চক্রান্ত করে বদলি করা হয়েছিল। তখন ময়মনসিংহবাসী রাস্তায় আন্দোলন করেছে। এরপর তার বদলির আদেশ বাতিল হয়।’
হাসপাতালের পরিচালক নাসির উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘হাসপাতালে যোগ দিয়ে আমি দেখেছি ব্যবস্থাপনার অভাবে এখানে মানুষের ভোগান্তি ছিল চরমে। গত আড়াই বছরে আমি হাসপাতালটিকে পরিবর্তনের চেষ্টা কিরেছি। রোগীবান্ধব করার চেষ্টা করেছি।’
‘যখন আমি হাসপাতালের দায়িত্ব পাই তখন বছরে ইউজার ফি জমা হতো চার কোটি টাকা। ২০১৮ সালে আমি ১২ কোটি টাকা ইউজার ফি সরকারকে দেব। সবকিছুই একটা সিস্টামের মধ্যে নিয়ে এসেছি। এ কারণে সম্ভব হচ্ছে।’
‘কর্মচারীরা আগে বেতন পেতো ১৪০০ টাকা। তাদের বেতন ছয় হাজার টাকা করেছি। তারা এখন আগের চেয়ে বেশি কাজ করছে। কাজে মনোযোগী হয়েছে।’
‘ট্রলিম্যান নিয়োগ দিয়েছি। যেটা আগে ছিল না। হাসপাতালে ৪৩ বছরে কোনো আনসার ছিল না। সেটিও আমি ব্যবস্থা করেছি। একসেস কন্ট্রোল করেছি। যেটা বাংলাদেশের কোনো হাসপাতালে নেই। এ কারণে অনেক দুর্নীতি, অনিয়ম বন্ধ হয়েছে।’
‘গত নভেম্বর থেকে ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করেছি। এরপরেই এক অসৎ গ্রুপের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। তারা পঙ্গপালের মতো। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য একটি মহল আমার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ।’
‘একটি গ্রুপ হাসপাতালে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায় জড়িত ছিল। ইনজুরি সার্টিফিকেট নিয়ে রমরমা ব্যবসা করত। সেটিও বন্ধ করে দিয়েছি। এখন এটি আমাকে দেখিয়ে দিতে হয়। আগে একজন পরিচালক এটির দায়িত্বে ছিলেন। সেখানে ব্যবসার সুযোগ ছিল। সেটি বন্ধ করে দিয়েছি।’
যুবলীগ নেতা ফারুকের বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক বলেন, ‘তিনি স্বাচিপের এক চিকিৎসকের ভাই। আমি শুরু থেকেই তাকে বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করেছি নিয়মের মধ্যে থেকে। কিন্তু এখন আর করতে পারছি না। কারণ আমারও সীমাবদ্ধতা আছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এ এইচ এম ফারুক তার বিরুদ্ধে উঠা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি। আমার প্রতিপক্ষ আছে। তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
‘আর আমি রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসা করি। গত ৮/১০ বছর ধরে আমি হাসপাতালে ঠিকাদারী ব্যবসা করি। সেখানে আমি নিয়মানুযায়ী সবাই যেইভাবে করে সেইভাবেই ব্যবসা করি। এখানে কাউকে জিম্মি করে কিছুই করি না।’
এক প্রশ্নের জবাবে ফারুক বলেন, ‘আমার কোনো আত্মীয় যদি চিকিৎসক হয়, তাহলে তার বদলির জন্য যদি আমি তদবির করি তাহলে সেটা কি দুর্নীতি বা অন্যায় হয়ে যাবে?’
বদলির হুমকি ও তদবিরের বিষয়ে জানতে চাইলে ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক এম এ গনি বলেন, ‘আমি যোগ দিয়েছি দুই মাস আগে। আমি আগে এগুলো শুনতাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার সঙ্গে এগুলো হয়নি। আমার কাছে কেউ অভিযোগ দেয়নি। বদলি আতঙ্কেও কেউ ভোগে না।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘তিন ধরনের বদলি হয়। একটা ন্যস্তকৃত চিকিৎসকদের বদলি, আরেকটি আবেদনের মাধ্যমে বদলি। আর সবশেষ প্রশাসনিক বদলি। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে এই বদলির ব্যবস্থা হয়। দুইমাসের মধ্যে আমার কাছে তিনি কোনো বদলি নিয়ে আসেননি।’
নিউজটি শেয়ার করুন
এ জাতীয় আরো খবর..