- প্রকাশিত : ২০১৮-০২-২৪
- ৮৬৫ বার পঠিত
-
নিজস্ব প্রতিবেদক
বৃহস্পতিবার রাত আটটা। ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরের ওয়াপদা কলোনি সড়ক। ৩০ ফুট চওড়া সড়কটি দখলে সরু হয়ে গেছে। সড়কের একপাশে থাকা ল্যাম্পপোস্টগুলোয় আলো জ্বলছে। অনেক খালি রিকশা যাত্রী ছাড়াই আসা-যাওয়া করছে। ছোট ছোট মুদি দোকান, হোটেল ও সেলুনে ভারতীয় হিন্দি গান উচ্চ স্বরে বেজে চলছে।
প্রতিটি দোকানে ক্রেতার কমতি নেই। রাস্তায় যাচ্ছে তিন-চারজনের ছোট ছোট দল। বেশির ভাগই ১৩ থেকে ১৭ বছরের কিশোর। এসব কিশোরের মধ্যে কেউ কেউ একলা দীর্ঘ সরু রাস্তার এমাথা-ওমাথা হাঁটছে। তাদের চোখ বারবার আছড়ে পড়ছে হাতের মোবাইল ফোনে। আর দেখে নিচ্ছে চারপাশ। কয়েকজন কিশোর আবার রাস্তার পাশে ওত পেতে আছে আঁধারে। সেখান থেকে এক কিশোর-কণ্ঠ বলে উঠল, ‘ভাই, কিছু লাগব? অহনই আইনা দিমু।’ কথায় উর্দু টান।
পাশ ফিরতেই সে কাছে ছুটে এল। একা নয়, সঙ্গে আরও দুজন। ছেলেটির মাথার সামনের চুল লম্বা, পেছনের চুল ছোট। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা। পরনে প্রিন্টের শার্ট ও থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট। শার্টের হাতা গোটানো। গলি আগলে দাঁড়িয়ে হাসছে ছেলেটি। হাসি কিছুটা থামিয়ে আবার বলল, ‘ছোটা-বাড়া (ছোট-বড়) যা-ই লাগব, আইনা দিমু।’
ওয়াপদা বিহারি কলোনি এলাকায় ‘ছোটা-বাড়া’ মানে গাঁজার ছোট-বড় প্যাকেট। কাগজে মোড়ানো প্যাকেটে গাঁজা বিক্রি হয়। গাঁজার ছোট প্যাকেট ৫০ টাকা, বড় প্যাকেট ১০০ টাকায় বিক্রি হয়। এই এলাকায় ‘গুটি’ পাওয়া যায়। ‘গুটি’ মানে ইয়াবা। ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় একটি ‘গুটি’। জিজ্ঞেস করতেই সশব্দে হেসে নাম বলল কিশোর। এই ছেলেটির মতো ২০ থেকে ২৫ জন কিশোর এই ‘গুটি’ আর ‘ছোটা-বাড়া’ বিক্রি করে। এ ধরনের কাজে পরিবারের উৎসাহ-সমর্থন রয়েছে। জানা গেছে, একজন কিশোর গাঁজা-ইয়াবা বিক্রি করে প্রতিদিন কমপক্ষে দুই হাজার টাকা আয় করে থাকে। এসব কিশোরের প্রতি রয়েছে এলাকার ‘মুরব্বিদেরও আদর ও ভালোবাসা’। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওয়াপদা কলোনির এক যুবক বলেন, ‘কিশোরদের ভালোবাসা তো থাকবোই। এই মুরব্বিরাই তো গাঁজা-ইয়াবার ব্যবসার মালিক।’
মালিকদের নাম জানতে চাইলে ওই যুবক বলেন, কামরান, মফিজ, সাউদ, মনসুর, নাদিমেরা দুই বর্গকিলোমিটার আয়তনের ওয়াপদা কলোনি এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। মাদক ব্যবসার সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন ব্যক্তি রয়েছেন।
রাতে জমজমাট মাদকের আসর
সরেজমিন দেখা গেছে, রাত যত গভীর হয়, এই এলাকায় মাদক ব্যবসা তত জমজমাট হয়। রাতের ব্যবসার শেষ পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা আসেন এখানে। তবে ক্রেতাদের বেশির ভাগই হেঁটে গাঁজা-ইয়াবা কিনতে আসেন। অনেকে আবার মোটরসাইকেলে করে আসেন। যাত্রীবিহীন রিকশাও মাদক পাচারের অন্যতম বাহন। রিকশাচালকেরা বাইরে থেকে ফরমাশ নেন। এরপর রিকশাসহ ওয়াপদা কলোনির ভেতর থেকে গাঁজা-ইয়াবার প্যাকেট নিয়ে বের হয়ে আসেন।
কিন্তু গাড়ি এলে ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই সতর্ক হয়ে যান। গাড়ি দেখলে বিক্রেতারা হাঁকডাক দেন না। ক্রেতারাও দ্রুত পালিয়ে যান। তাঁদের ধারণা, গাড়িতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালাতে পারে। এ সময় মাদক ব্যবসায়ীদের সতর্ক করার কাজটি করে থাকে কিশোরের দল। লাভজনক এই ব্যবসায় কিশোরেরাই প্রধান ‘হাতিয়ার’। অন্যভাবে বলা যায়, মাদকদ্রব্য নিয়ে ব্যবসার ‘ঘুঁটি’। তাদের দিয়ে দান চেলে ফায়দা লোটা হয়।
ওয়াপদা কলোনির ভেতরের অবস্থা আরও ভয়াবহ। অচেনা যে-কেউ ভেতরে গেলে পথ হারিয়ে ফেলতে পারেন। মাকড়সার মতো অসংখ্য ছোট ছোট গলি রয়েছে কলোনির ছয়টি ভবনের আশপাশে। প্রতিটি গলি তিন ফুটের বেশি চওড়া নয়। কলোনির ৩ ও ৪ নম্বর ভবনসংলগ্ন এলাকায় আছে অসংখ্য দরজির দোকান, বেনারসির তাঁত ও সেলুন। রয়েছে ছোট ছোট ঘর।
এসব ঘরের মধ্যে কয়েকটিতে আবার তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন মানুষ বসবাস করেন। তাঁদের খপ্পরে পড়লে বেশি দাম দিয়ে গাঁজা-ইয়াবা কিনতে হয়। অপরিচিত লোকজন আবার ছিনতাইয়ের শিকার হয়ে থাকেন। ওয়াপদা কলোনির ৩ ও ৪ নম্বর ভবনের নিচেও মাদক বিক্রির জন্য কিশোরদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। আগন্তুক কাউকে দেখলেই তাদের প্রশ্ন, ‘কিছু লাগব?’
কলোনির ৩ ও ৪ নম্বর ভবনের পূর্ব পাশে ইয়াবা বিক্রি করেন কামরান। তার পাশের কক্ষে গাঁজা বিক্রি করেন মনসুর। মনসুরের ঘরের বাঁ পাশে ইয়াবা বিক্রি করেন শাহজাদ। এখান থেকে সোজা এলে মফিজের ঘরেও গাঁজা পাওয়া যায়। মফিজের ঘর থেকে সরু গলি ধরে গেলে পড়বে তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের ঘর। এখানেও গাঁজা বিক্রি হয়। ওয়াপদা কলোনির ৩ ও ৪ নম্বর ভবনের মধ্যে রয়েছে একটি মাঠ। এই মাঠে রাতে অসামাজিক কর্মকাণ্ডে তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। প্রতিদিন যা আয় হয়, তার প্রায় সবই অসামাজিক কাজ করতে গিয়ে খরচ করে মাদক বিক্রিতে জড়িত বেশির ভাগ কিশোর। মাঠটির মাঝখানে পয়োনিষ্কাশনের পানি সারা বছর জমে থাকে। চারদিকে আবর্জনার স্তূপ।
ওয়াপদা কলোনির এক বাসিন্দা বলেন, এই স্তূপের পাশে চলে সব অসামাজিক কাজ। টাকা-পয়সা নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে।
জানা গেছে, অর্ধলক্ষাধির বাসিন্দা ওই ওয়াপদা কলোনি এলাকায় বসবাস করে। সবাই অবাঙালি। এদের মধ্যে শ খানেক লোক মাদক ব্যবসা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।
মাদকের মামলায় অর্ধশত আসামি উঠতি বয়সী
মিরপুরে আরেকটি মাদকের আস্তানা এডিবি কলোনি। মিরপুর ১১ নম্বর কাঁচাবাজারের পশ্চিম পাশে এই কলোনিতে কোনো দ্বিতল ভবন নেই। সব ছোট ছোট টিনশেড ঘর। শতাধিক পরিবারের বসবাস। এখানেও সবাই অবাঙালি। এডিবি কলোনিতেও প্রতিদিন রাত একটা পর্যন্ত চলে মাদক বিক্রি। এখানে বারব ও হাল্লো নামে তৃতীয় লিঙ্গের দুজন এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁরা নিজেদের দুই বোন বলে দাবি করেন। তাঁদের ৩০ সদস্যের একটি বাহিনী মাঠপর্যায়ে গাঁজা ও ইয়াবা বিক্রি করে। তবে বেশি তৎপর ১৫ জনের একদল কিশোর।
পল্লবী থানার পুলিশের তথ্য অনুসারে, এই এলাকায় ৪০টির মতো বিহারি ক্যাম্প রয়েছে। এসব ক্যাম্পেই মাদকের ব্যবসা বেশি। পল্লবী এলাকায় প্রতি মাসে গড়ে অর্ধশতাধিক মাদকের মামলা হয়ে থাকে। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের মদদে এসব ক্যাম্পে মাদকের ব্যবসা চলে বলে জানান শীর্ষ এক পুলিশ কর্মকর্তা।
এ ব্যাপারে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) দাদন ফকির প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনের মধ্যে, পুলিশের মধ্যে, রাজনীতিবিদদের মধ্য, এমনকি সাংবাদিকদের মধ্য খারাপ লোক আছেন। এঁদের কারণে মাদক ব্যবসা পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছে না। তাঁরা যদি এক হতেন, তাহলে এই ব্যবসা বন্ধ করা যেত। এখন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ইয়াবা। তবে এখন প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা বন্ধ করা গেছে বলে তিনি দাবি করেন। তিনি বলেন, ৭৫ শতাংশ মাদক ব্যবসা নির্মূল করা গেছে। এখন প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা হয় না। সচেতন করতে বিভিন্ন এলাকায় উঠোন বৈঠক করে মাদকাসক্তদের কাউন্সেলিং করানো হয়। অভিভাবকদের সচেতন করা হচ্ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীর মিরপুর এলাকায় ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে মাদক বিক্রির ঘটনায় ১০২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই আসামিদের এর মধ্যে অর্ধশত আসামি উঠতি বয়সী ছেলে। এদের বড় অংশ মিরপুরের অবাঙালি-অধ্যুষিত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে।
মাদক ব্যবসা থেকে পেশাদার সন্ত্রাসী
কিশোর বয়সে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী হওয়ার দৃষ্টান্ত হলেন নাদিম হোসেন ওরফে পঁচিশ। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প থেকে তাঁকে গত ৩ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয়।
জানা যায়, ৩১ বছর বয়সী নাদিম ওরফে পঁচিশ ছোটবেলায় জেনেভা ক্যাম্প এলাকার একটি হোটেলে ২৫ টাকা দৈনিক বেতনে কাজ করতেন। হোটেলে কাজ করতে করতে গাঁজা বিক্রি শুরু করেন। সাদা কাগজে মোড়ানো এক পুঁটলি গাঁজা বিক্রি করতেন ২৫ টাকায়। হোটেলের বেতন আর গাঁজার দাম একই হওয়ায় নাদিমকে এলাকাবাসী ডাকতে শুরু করে ‘পঁচিশ’ নামে। একসময় নাদিম নিজেই ‘পঁচিশ’ নামে পরিচয় দিতে শুরু করেন। এই পঁচিশ যুবক হয়ে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটিয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় হত্যাসহ ১২টির মতো মামলা রয়েছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল প্রথম আলোকে বলেন, মাদক, অপরাধ ও যৌনতা একটি বৃত্তের মধ্যে থাকে। মাদক বহন করতে গিয়ে একজন কিশোর ওই প্যাকেট খোলে। সেখান থেকে সে মাদকাসক্ত হয়। আসক্ত হলে ওই কিশোরের টাকার প্রয়োজন হয়। তখন ডিলাররা তাকে ২০টি ইয়াবা বিক্রি করলে দুটি বিনা মূল্যে দেওয়ার কথা বলে। এভাবে মাদকের সঙ্গে জড়িত কিশোরদের ভবিষ্যতে পেশাদার সন্ত্রাসী হওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে।
কিশোরদের মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া ও আসক্ত হওয়া থেকে দূরে রাখার জন্য সামাজিক সচেতনতার ওপর জোর দিলেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীরা পথশিশুসহ কিশোরদের ব্যবহার করছে। শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করছি। তবে তারা দ্রুত আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। তবে কিশোরদের মাদকের বিরুদ্ধের সচেতন করতে বস্তিগুলোয় অনেক সভা করেছি। সম্প্রতি ১০জন শিশুকে নিরাময় কেন্দ্রে পাঠিয়েছি। মাদকের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরতে বিষয়টি পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে আমরা অনুরোধ করেছি।’
নিউজটি শেয়ার করুন
এ জাতীয় আরো খবর..