বাংলাদেশে প্রতিবছর বাজেট ঘোষণার সময় আসলেই বিড়ির উপর করবৃদ্ধি ঠেকাতে শ্রমিকদের আন্দোলন করতে দেখা যায়। এমনকি বাজেট পাস হওয়ার পরেও এই আন্দোলন চলতে থাকে। অথচ বিড়ি শ্রমিকদের এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত নয়, মালিকদের সাজানো। গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) পরিচালিত ‘বাংলাদেশে বিড়িশ্রমিক আন্দোলনের কারণ অনুসন্ধান: একটি গুণগত বিশ্লেষণ’ শীর্ষক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। আজ রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে প্রজ্ঞা এবং অ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স (আত্মা) এই গবেষণার ফল প্রকাশ করে। ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস্ (সিটিএফকে) এই গবেষণায় সার্বিক সহায়তা প্রদান করেছে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। বাংলাদেশ এর লিড পলিসি অ্যাডভাইজর মো. মোস্তাফিজুর রহমান এন সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসির উদ্দিন আহমদ। বক্তব্য রাখেন জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়কারী ও অতিরিক্ত সচিব হোসেন আলী খোন্দকার, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এর রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর প্রমুখ ।
বাংলাদেশে বিড়ি শিল্পের নিবিড়তা, শ্রমিক আন্দোলন সংঘটনের প্রবণতা এবং তীব্রতার ওপর ভিত্তি করে লালমনিরহাট, রংপুর, পাবনা এবং কুষ্টিয়া জেলায় ২০২১ সালে গবেষণা কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়। বিড়ি শ্রমিক, শ্রমিক নেতা এবং স্থানীয় সুশীল সমাজ ও সংগঠন থেকে উদ্দেশ্যমূলক নমুনায়নের ভিত্তিতে মোট ৯২ জনকে এই গবেষণার জন্য নির্বাচন করা হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়ি শ্রমিকদের এই আন্দোলন আয়োজনের পুরো দায়িত্বে থাকে মালিক পক্ষের কিছু লোক এবং বিড়ি কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার ও এজেন্ট। বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন কর্মসূচিগুলোতে তথাকথিত শ্রমিক নেতাদের সাথে কোম্পানির লোকজনও বক্তৃতা দেয়। শ্রমিকদের কাজ শুধু রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা। মূলত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিড়ি শ্রমিকদের ঢাকায় নিয়ে আসে বিড়ি কোম্পানির মালিকরা। আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য শ্রমিকদের পরিবহন, খাবারসহ সকল ব্যয় মালিক পক্ষ বহন করে। নিজস্ব অর্থ দিয়ে এসব আন্দোলনে অংশ নেয়ার সামর্থ্য দরিদ্র বিড়ি শ্রমিকদের নেই।
ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, গবেষণার ফলাফলের সাথে আমি একমত। এটা একটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ খাত। সরকারের উচিত হবে এই শিল্পকে নিরুৎসাহিত করা। মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শ্রমিক শোষণের বড় উদাহরণ হচ্ছে বিড়ি শিল্প। সাজানো আন্দোলনে প্রকৃত লাভবান হয় মালিক পক্ষই। ড. নাসির উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিড়ি শ্রমিকদের আন্দোলন যে সাজানো সে বিষয়ে আমি শতভাগ একমত। কারণ এনবিআর চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় আমি এগুলো দেখেছি।’ হোসেন আলী খোন্দকার বলেন, বিড়ি শিল্পে শিশু শ্রম ব্যবহার বন্ধ করতে কঠোর মনিটরিং করতে হবে। ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ‘স্বল্প আয়ের মানুষেরাই বিড়ির প্রধান ভোক্তা। উচ্চ হারে করারোপ করে বিড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে হবে।’
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, বিড়ির দাম বাড়লে বিড়ি বন্ধ হয়ে যাবে, শ্রমিকদের কাজ থাকবে না, সরকার বিড়ি শিল্প বন্ধ করে দিতে চায় এসব ভয় দেখিয়ে বিড়ি শ্রমিকদের আন্দোলনে নামায় মালিক পক্ষ। অনেক ক্ষেত্রে আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করলে শ্রমিক কার্ড বাতিল কিংবা কারখানা বন্ধ রাখার হুমকিও দেয়া হয়। ফলে বিড়ি শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে করবৃদ্ধি ঠেকানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। গবেষণায় বিড়ি শ্রমিকদের কল্যাণে নিয়োজিত কোনো শ্রমিক সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বিড়ি শ্রমিকদের অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে দাবি করা সংগঠনগুলো মূলত মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে, প্রকৃত বিড়ি শ্রমিকরা এসব সংগঠনের সদস্য নয়। বিড়ি কারখানাগুলোতে শ্রমিক ইউনিয়ন বা অ্যাসোসিয়েশন খোলার অনুমতি দেয়া হয় না বরং বিভিন্ন কারখানায় শ্রমিকরা অ্যাসোসিয়েশন চালু করার চেষ্টা করায় অনেকেই কাজ হারিয়েছেন বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিড়ি শ্রমিকদের এই আন্দোলনে প্রকৃত লাভবান হয় বিড়ি মালিকরাই। ২০১৯ সালে বিড়ি শ্রমিকদের আন্দোলনের ফলে বিড়ির উপর বর্ধিত কর প্রত্যাহার করে নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। ফলে এক হাজার শলাকা বিড়িতে মালিকদের আয় বৃদ্ধি পায় ২৮ টাকা। অথচ শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয় প্রতি হাজারে মাত্র ৬ টাকা। উল্লেখ্য, বাজেটে বিড়ির শুল্ক না বাড়িয়ে কেবল খুচরামূল্য বৃদ্ধি করায় ২০১৮-২০২০ এই তিন বছরে প্রতি ১ হাজার শলাকায় মালিকদের মুনাফা বেড়েছে ১১৮.৮ টাকা।
গবেষণায় দরিদ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে বিড়ির ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে বিড়ির ওপর উচ্চহারে করারোপ করা, বর্ধিত কর থেকে আহরিত রাজস্ব বিড়ি শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যয় করা, কর আইন ও শ্রম আইন বিশেষত শিশুশ্রম ব্যবহার সংক্রান্ত আইন প্রতিপালনে বিড়ি শিল্পকে কঠোর মনিটরিংয়ের আওতায় আনা এবং বিড়ি শিল্প মালিকদের বিকল্প ব্যবসায় যেতে সরকারের পক্ষ থেকে ঋণসহ অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান প্রভৃতি সুপারিশ করা হয়।
আত্মা’র কো-কনভেনর নাদিরা কিরণের পরিচালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন প্রজ্ঞা’র হাসান শাহরিয়ার। আত্মা’র কনভেনর মর্তুজা হায়দার লিটন, গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটর (জিএইচএআই) এর বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড মুহাম্মদ রূহুল কুদ্দুস, প্রজ্ঞা’র নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়েরসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধি এবং তামাকবিরোধী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।