জাপান থেকে আসা সেই দুই শিশু ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকবে। তাদের বাবা নির্ধারিত সময় অনুযায়ী শিশুদের সাথে দেখা করতে পারবেন বলে আদেশ দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী’র নেতৃত্বে আপিল বিভাগ আজ এই আদেশ দেন।
আদেশে আদালত বলেন, এ সময়ের মধ্যে শিশুদের মাকে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত লিভ টু আপিল দায়ের করতে বলা হয়েছে।
আদালতে জাপানি মায়ের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র এডভোকেট আহসানুল করিম। তাকে সহযোগিতা করেন এডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফের পক্ষে ছিলেন এডভোকেট ফাওজিয়া করিম। তাকে সহযোগিতা করেন ব্যারিস্টার মারুফুল ইসলাম।
এর আগে ১৫ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ আদেশে বলেন, দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত জাপানি মা নাকানো এরিকোর কাছে থাকবে। তবে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯ টার মধ্যে যে কোন সময় বাবা ইমরান শরীফ শিশুদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।
এর আগে গত ৫ ডিসেম্বর দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে নিজের জিম্মায় নিতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন জাপানি মা নাকানো এরিকো।
গত ২১ নভেম্বর জাপানি দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনা বাংলাদেশে তাদের বাবা ইমরান শরীফের কাছে থাকবে বলে রায় দেন হাইকোর্ট। সে রায়ে বলা হয়, জাপান থেকে এসে মা বছরে তিন বার ১০ দিন করে দুই সন্তানের সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে পারবেন। জাপানি মায়ের আসা-যাওয়া ও থাকা-খাওয়ার সব খরচ বাবা ইমরান শরীফকে বহন করতে হবে। রায়ে বলা হয়, রিটটি চলমান থাকবে।
এর আগে গত ১৩ ডিসেম্বর দুই শিশু জেসমিন মালিকা, লাইলা লিনা ও তাদের বাবা মায়ের সঙ্গে আপিল বিভাগের বিচারপতিরা খাস কামরায় কথা বলেন। ওইদিন সকালে দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে বেলা সাড়ে ১১টার মধ্যে আপিল বিভাগে হাজির করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। জাপানি মায়ের আনা আদালত অবমাননার আবেদনের শুনানি নিয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন। শিশুদের বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফকে এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। সে অনুযায়ী শিশুদের উপস্থিত করা হয়েছিল।
আপিল বিভাগের আদেশ থাকা সত্ত্বেও দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে হস্তাস্তর না করায় শিশুদের বাবা ইমরান শরীফের বিরুদ্ধে এ আদালত অবমাননার আবেদনটি করা হয়। ১৩ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় এ আবেদন করা হয়। এর আগে ১২ ডিসেম্বর দুই শিশু জেসমিন মালিকা ও লাইলা লিনাকে ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর জাপানি মায়ের জিম্মায় রাখতে নির্দেশ দেন আপিল বিভাগ।
এরিকোর আইনজীবী শিশির মনির জানান, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানি নাগরিক ডা. এরিকো নাকানো (৪৬) ও বাংলাদেশি আমেরিকান নাগরিক শরীফ ইমরান (৫৮) জাপানি আইনানুসারে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা টোকিওতে বসবাস শুরু করেন। ১২ বছরের সংসারে তিনজন কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তারা হলো- জেসমিন মালিকা (১১), লাইলা লিনা (১০) ও সানিয়া হেনা (৭)। এরিকো পেশায় একজন চিকিৎসক। তিন মেয়ে টোকিওর চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপানের (এএসজেআই) শিক্ষার্থী ছিল।
২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি ইমরান তার স্ত্রী এরিকোর সঙ্গে ডিভোর্স আবেদন করেন। এরপর ২১ জানুয়ারি ইমরান স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে তার মেয়ে জেসমিন মালিকাকে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। কিন্তু তাতে এরিকোর সম্মতি না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ তার প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। পরে স্কুলবাসে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান তাদের বড় দুই মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে অন্য একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান। চারদিন পর ২৫ জানুয়ারি ইমরান তার আইনজীবীর মাধ্যমে এরিকোর কাছে সন্তানদের পাসপোর্ট হস্তান্তরের আবেদন করেন। কিন্তু এরিকো তা প্রত্যাখ্যান করেন। এর মধ্যে ২৮ জানুয়ারি এরিকো টোকিওর পারিবারিক আদালতে তার সন্তানদের জিম্মার জন্য অন্তবর্তীকালীন আদেশ চেয়ে মামলা করেন। আদালত ৭, ১১ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি পারিবারিক সাক্ষাতের আদেশ দেন। ইমরান আদালতের আদেশ ভঙ্গ করে মাত্র একবার মায়ের সঙ্গে দুই মেয়ের সাক্ষাতের সুযোগ দেন।
এদিকে ৯ ফেব্রুয়ারি মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ইমরান তার মেয়েদের জন্য নতুন পাসপোর্টের আবেদন করেন এবং ১৭ ফেব্রুয়ারি নতুন পাসপোর্ট নেন। পরে ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি দুই মেয়ে জেসমিন ও লিনাকে নিয়ে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ৩১ মে টোকিওর পারিবারিক আদালত এরিকোর অনুকূলে জেসমিন ও লিনার জিম্মা হস্তান্তরের আদেশ দেন। পরে ছোট মেয়ে সানিয়া হেনাকে মায়ের কাছে রেখে ১৮ জুলাই এরিকো শ্রীলঙ্কা হয়ে বাংলাদেশে আসেন। পরে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আদালত গুলশানে একটি ভাড়া বাসায় সবাইকে আলাদা কক্ষে বসবাসের অনুমতি দেন। পাশাপাশি সমঝোতা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। কিন্তু উভয়পক্ষের আইনজীবীরা কয়েকবার বৈঠকেও সমঝোতায় আসতে পারেনি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট মেয়েদের এরিকোর সঙ্গে গুলশানের বাসায় থাকার আদেশ দেন। আর বাবা ইমরান শরীফকে দিনের বেলা তাদের সঙ্গে দেখা ও সময় কাটাতে পারবেন বলে সুযোগ দেন। পরে ৩১ অক্টোবর ২ রিটের শুনানি শেষে ২১ নভেম্বর রায় দেন হাইকোর্ট। সে রায়ের বিষয়ে আমরা আপিল বিভাগে আবেদন করি।