বাংলাদেশের ছুঁেড় দেয়া ১৭২ রানের টার্গেটে এক সময় সাকিব আল হাসানের জোড়া আঘাতে ৭৯ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে চাপেই পড়েছিলো শ্রীলংকা। এরপর ম্যাচে টিকে থাকার লড়াইয়ের পথে ক্যাচ দেন চারিথ আসালঙ্কা ও ভানুকা রাজাপাকসে। আসালঙ্কা-রাজাপাকসের দেয়া দুই ক্যাচ ফেলে বাংলাদেশকে হারের মুখে ঠেলে দেন লিটন দাস।
শেষ পর্যন্ত পঞ্চম উইকেটে আসালঙ্কা ও রাজাপাকসের ৫২ বলে ৮৬ রানের দুর্দান্ত জুটিতে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সুপার টুয়েলভে গ্রুপ-১এ নিজেদের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশকে ৫ উইকেটে হারিয়েছে শ্রীলংকা।
ওপেনার মোহাম্মদ নাইম ও মুশফিকুর রহিমের জোড়া হাফ-সেঞ্চুরিতে শ্রীলংকার বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে ২০ ওভারে ৪ উইকেটে ১৭১ রান করেছিলো বাংলাদেশ। নাইম ৬২ ও মুশফিক অপরাজিত ৫৭ রান করেন। জবাবে আসালঙ্কা-রাজাপাকসের জোড়া হাফ-সেঞ্চুরিতে ৭ বল বাকী রেখে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে শ্রীলংকা। আসালঙ্কা অপরাজিত ৮০ ও রাজাপাকসে ৫৩ রান করেন।
শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ম্যাচে এবার আর টস জিততে পারেননি বাংলাদেশ অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। বাছাই পর্বের তিন ম্যাচেই টস জিতেছিলেন তিনি। টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠায় শ্রীলংকা। বাছাই পর্বের শেষ ম্যাচের একাদশ থেকে একটি পরিবর্তন এনে শারজাহ ক্রিকেট স্টেডিয়ামে খেলতে নামে টাইগাররা। ডান-হাতি পেসার তাসকিন আহমেদের পরিবর্তে সেরা একাদশে সুযোগ পান বাঁ-হাতি স্পিনার নাসুম আহমেদ।
প্রথমে ব্যাট করার সুবিধাটা ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার মোহাম্মদ নাইম ও লিটন দাস। তবে সাবধানী শুরু ছিলো তাদের। প্রথম ওভারে না পারলেও দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম পর্যন্ত প্রতিটি ওভারেই একটি করে বাউন্ডারি হাকান নাইম-লিটন।
দুই ওপেনারের দৃঢ়তায় ৫ ওভার শেষে ৩৮ রান পেয়ে যায় বাংলাদেশ। ষষ্ঠ ওভারে এই জুটি ভাঙ্গেন শ্রীলংকার পেসার লাহিরু কুমারা। উইকেট থেকে সামান্য সড়ে মিড-অফ দিয়ে বাউন্ডারি আদায়ের চেস্টা করেন লিটন। কিন্তু শটটা যুৎসই না হওয়াতে সেটি তালুবন্দি করেন শ্রীলংকার অধিনায়ক দাসুন শানাকা। ল্টিন ব্যক্তিগত ১৬ বলে ১৬ এবং দলীয় ৪০ রানে প্রথম উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
এরপর ক্রিজে নাইমের সঙ্গী হন সাকিব আল হাসান। সপ্তম ওভারে বাংলাদেশের স্কোরে ১৪ রান জমা করেন তারা। সাকিব দু’টি ও নাইম একটি বাউন্ডারি মারেন। দ্রুত রান তুলে উইকেটে সেট হবার পথে ছিলেন সাকিব। তবে সেটি আর সম্ভব হয়নি। অষ্টম ওভারে উইকেট থেকে সড়ে লেগ সাইড দিয়ে ফ্লিক শট খেলতে টাইমিং মিস করেন সাকিব। শ্রীলংকার পেসার চামিকা করুনারতেœর ডেলিভারি উইকেট ভেঙ্গে দিলে ৭ বলে ১০ রান করে আউট হন সাকিব।
ভালো শুরুর পরও ১৪ রানের ব্যবধানে ২ উইকেট পতনে কিছুটা চাপে পড়ে বাংলাদেশ। দলকে চাপ থেকে মুক্ত করতে সাবধানে এগোতে থাকেন নাইম ও চার নম্বরে নামা মুশফিক। পরের ১৭ বলে কোন বাউন্ডারি বা ওভার বাউন্ডারি পায়নি বাংলাদেশ।
১১তম ওভারের চতুর্থ বলে শ্রীলংকার স্পিনার হাসারাঙ্গা ডি সিলভাকে স্লগ সুইপে ডিপ মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা মেরে ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন মুশফিক। এখানেই নিজেকে গুটিয়ে রাখেননি মুশি। ১৩তম ওভারের প্রথম বলে শ্রীলংকার বাঁ-হাতি পেসার বিনুরা ফার্নান্দোকে স্কয়ার লেগ দিয়ে আবারো ছক্কা হাকান তিনি।
মুশফিকের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রানের গতি ধরে রাখার চেষ্টায় ছিলেন নাইম। ১৪তম ওভারের চতুর্থ বলে বাউন্ডারি দিয়ে হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন তিনি। ৪৪ বলে এবারের আসরের দ্বিতীয় ও ২৫ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে চতুর্থ অর্ধশতক করেন নাইম।
১৬ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান গিয়ে দাঁড়ায় ২ উইকেট ১২৯ রানে। ক্রিজে দুই সেট ব্যাটসম্যান থাকায় বড় সংগ্রহের স্বপ্ন দেখছিলো বাংলাদেশ। কিন্তু ১৬তম ওভারের প্রথম বলে উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ফার্নান্দোকে পুল শটে মারতে গিয়ে তাকেই ক্যাচ দেন নাইম। ৬টি চারে ৫২ বলে ৬২ রান করেন নাইম। বাছাই পর্বে ওমানের বিপক্ষে ৬৪ রান করেছিলেন তিনি। মুশফিকের সাথে তৃতীয় উইকেটে ৫১ বলে ৭৩ রান যোগ করেন নাইম। যেখানে নাইম ৩৪ ও মুশফিক ৩৭ রানের অবদান রাখেন।
নাইমের বিদায়ের ওভারে ১১ রান তোলেন মুশফিক ও আফিফ হোসেন। আর ১৯তম ওভারের প্রথম বলে হাফ-সেঞ্চুরির স্বাদ নেন মুশি। ৩২ বলে আসে তার কাঙ্খিত হাফ-সেঞ্চুরি। ১১ ইনিংস পর সংক্ষিপ্ত ভার্সনে হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। ৯৫ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে ষষ্ঠ হাফ-সেঞ্চুরি মুশফিকের।
৭ রান করে আফিফ রান আউট হলে, শেষ নয় বলে ২১ রান যোগ করেন মুশফিক ও অধিনায়ক মাহমুদুল্লাহ। এ সময় মাহমুদুল্লাহ ২টি ও মুশফিক ১টি বাউন্ডারি মারেন। ফলে ২০ ওভারে ৪ উইকেটে ১৭১ রানের বড় সংগ্রহ পায় বাংলাদেশ।
মুশফিক ৩৭ বলে ৫টি চার ও ২টি ছক্কায় অপরাজিত ৫৭ রান করেন। ২টি চারে ৫ বলে অপরাজিত ১০ রান করেন মাহমুদুল্লাহ। শ্রীলংকার করুনারতেœ-ফার্নান্দো-কুমারা ১টি করে উইকেট নেন।
শ্রীলংকাকে ১৭২ রানের টার্গেট ছুঁেড় দিয়ে বোলিং ইনিংসের শুরুতেই বাংলাদেশকে দারুন শুরু এনে দেন এবারের বিশ্বকাপে প্রথবারের মত খেলতে নামা স্পিনার নাসুম আহমেদ। ইনিংসের চতুর্থ বলেই শ্রীলংকার ওপেনার ১ রান করা কুশল পেরেরাকে বোল্ড করেন নাসুম।
শুরুতেই উইকেট হারলেও, দলকে চাপে পড়তে দেননি আরেক ওপেনার পাথুম নিশাঙ্কা ও চারিথ আসালঙ্কা। পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশের উপর চড়াও হন আসালঙ্কা। তার ১৮ বলে ৩৬ রানের সুবাদে পাওয়ার প্লেতে ৫৪ রান পায় শ্রীলংকা। অন্যপ্রান্তে উইকেটে সেটও হয়ে যান নিশাঙ্কা। তাই এই জুটিকে ভাঙ্গতে মরিয়া ছিলো বাংলাদেশ।
নবম ওভারে দ্বিতীয়বারের মত বোলিং আক্রমনে এসে বাংলাদেশকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন সাকিব। ওভারের প্রথম বলে নিশাঙ্কাকে বোল্ড করেন তিনি। সেই সাথে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হয়ে যান সাকিব।
ঐ ওভারের চতুর্থ বলে আরও একটি উইকেট শিকার করেন সাকিব। আভিস্কা ফার্নান্দোকেও দারুন এক ডেলিভারিতে বোল্ড করেন তিনি। খালি হাতে ফিরেন ফার্নান্দো।
সাকিবের জোড়া আঘাতের সাথে উইকেট শিকারের আনন্দে মেতে উঠেন সাইফুদ্দিনও। পাঁচ নম্বরে নামা হাসারাঙ্গা ডি সিলভাকে ৬ রানে থামান সাইফুদ্দিন। ফলে ৪ উইকেটে ৭৯ রানে পরিণত হয় শ্রীলংকা। ঐ অবস্থায় ১০ ওভারে ৯২ রান প্রয়োজন ছিলো শ্রীলংকার।
নতুন ব্যাটার ভানুকা রাজাপাকসেকে নিয়ে সাবধানে খেলতে থাকেন আসালঙ্কা। এই জুটি ভাঙ্গতে অকেশনাল বোলার আফিফকে আক্রমনে আনেন মাহমুদুল্লাহ। ১৩তম ওভারের প্রথম বলেই আফিফকে ছক্কা মারেন রাজাপাকসে। আর চতুর্থ বলে স্কয়ার লেগে ক্যাচ দেন রাজাপাকসে। সেই ক্যাচ ফেলেন লিটন। ঐ বলে চার রানও পায় শ্রীলংকা। ১ বল পর ৩২ বলে টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে প্রথম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে নেন রাজাপাকসে।
ক্যারিয়ারের পঞ্চম ম্যাচে হাফ-সেঞ্চুরি পেয়ে মারমুখী হয়ে উঠেন আসালঙ্কা। ১৪তম ওভারে মাহমুদুল্লাহকে দু’টি ছক্কা মারেন তিনি। পরের ওভারে জীবন পান আসালঙ্কা। বাংলাদেশের পেসার মুস্তাফিজের বলে ক্যাচ দিয়েছিলেন তিনি। সেই ক্যাচটিও ফেলেন লিটন। তখন ৬৩ রানে দাঁড়িয়ে আসাঙ্কা। এমন অবস্থায় জয়ের জন্য ৩৩ বলে ৪৯ রান দরকার ছিলো শ্রীলংকার।
১৮ রানে জীবন পাওয়া রাজাপাকসে, ১৬তম ওভাওে সাইফুদ্দিনের বলে ২টি ছক্কা ও চারে ২২ রান তুলে ম্যাচের লাগাম নিয়ে নেন।
১৮তম ওভারে এসে ২৮ বলে ১৪ ম্যাচের ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন বার্থ-ডে বয় রাজাপাকসে।
আসালঙ্কা-রাজাপাকসের ব্যাটিং তান্ডবে শেষ দুই ওভারে জিততে ৯ রান প্রয়োজন পড়ে শ্রীলংকার। ১৯তম ওভারে রাজাপাকসেকে বোল্ড করেন নাসুম। ফলে বিচ্ছিন্ন হন লিটনের হাতে জীবন পাওয়া আসালঙ্কা-রাজাপাকসে জুটি । পঞ্চম উইকেটে ৫২ বলে ৮৬ রান যোগ করে শ্রীলংকার জয়ের পথ সুগম করেন তারা।
রাজাপাকসের বিদায়ের পর ঐ ওভারের পঞ্চম বলে বাউন্ডারি মেরে শ্রীলংকার জয় নিশ্চিত করেন আসালঙ্কা। ৪৯ বলে ৫টি করে চার-ছক্কাঢ অপরাজিত ৮০ রান করেন আসালঙ্কা। ৩১ বলে ৩টি করে চার-ছক্কায় ৫৩ রান করেন রাজাপাকসে। বাংলাদেশের নাসুম-সাকিব ২টি করে এবং সাইফুদ্দিন ১টি উইকেট নেন।
আগামী ২৭ অক্টোবর সুপার টুয়েলভে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।
স্কোর কার্ড : (টস- শ্রীলংকা)
বাংলাদেশ ইনিংস :
নাইম ক এন্ড ব ফার্নান্দো ৬২
লিটন ক শানাকা ব কুমারা ১৬
সাকিব বোল্ড ব করুনারতেœ ১০
মুশফিকুর অপরাজিত ৫৭
আফিফ রান আউট (কুমারা) ৭
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ অপরাজিত ১০
অতিরিক্ত (বা-২, লে বা-৩, নো-৩, ও-১) ৯
মোট (৪ উইকেট, ২০ ওভার) ১৭১
উইকেট পতন : ১/৪০ (লিটন), ২/৫৬ (সাকিব), ৩/১২৯ (নাইম), ৪/১৫০ (আফিফ)।
শ্রীলংকা বোলিং :
করুনারতেœ : ৩-০-১২-১,
ফার্নান্দো : ৩-০-২৭-১,
চামিরা : ৪-০-৪১-০ (নো-২),
কুমারা : ৪-০-২৯-১ (নো-১),
আসালঙ্কা : ১-০-১৪-০,
হাসারাঙ্গা : ৩-০-২৯-০,
শানাকা : ২-০-১৪-০ (ও-১)।
শ্রীলংকা ইনিংস :
পেরেরা বোল্ড ব নাসুম ১
নিশাঙ্কা বোল্ড ব সাকিব ২৪
আসালঙ্কা অপরাজিত ৮০
ফার্নান্দো বোল্ড ব সাকিব ০
হাসারাঙ্গা ক নাইম ব সাইফুদ্দিন ৬
রাজাপাকসে বোল্ড ব নাসুম ৫৩
শানাকা অপরাজিত ১
অতিরিক্ত (ও-৭) ৭
মোট (৫ উইকেট, ১৮.৫ ওভার) ১৭২
উইকেট পতন : ১/২ (পেরেরা), ২/৭১ (নিশাঙ্কা), ৩/৭১ (ফার্নান্দো), ৪/৭৯ (হাসারাঙ্গা), ৫/১৬৫ (রাজাপাকসে)।
বাংলাদেশ বোলিং :
নাসুম : ২.৫-০-২৯-২,
মাহেদি : ৪-০-৩০-০ (ও-২),
সাইফুদ্দিন : ৩-১-৩৮-১ (ও-২),
সাকিব : ৩-০-১৭-২,
মুস্তাফিজ : ৩-০-২২-০ (ও-২),
মাহমুুদুল্লাহ : ২-০-২১-০ (ও-১),
আফিফ : ১-০-১৫-০।
ফল : শ্রীলংকা ৫ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : চারিথ আসালঙ্কা (শ্রীলংকা)।