মানবপাচারের শিকার মাহবুবসহ ১০ জনকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়।
নিজস্ব প্রতিনিধি:-
‘গহিন বনে খালের পানিতে বুক পর্যন্ত নামিয়ে রাখা হয়। দিনের পর দিন না খেয়ে ওভাবেই বুকপানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। খেতে চাইলে কেবল পানি খেতে দেওয়া হতো। আর মারধর তো ছিলই। অথচ কান্নার শব্দ বন পেরিয়ে কোথাও যেত না।’
এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনান মাহবুব আলম। কাজের খোঁজে মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। গত ২৮ নভেম্বর অপহরণের শিকার হন মাহবুব। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার পুলিশের দক্ষতায় প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছেন তিনি। গত ১ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার পাহাং এলাকার একটি বন থেকে মাহবুবকে উদ্ধার করা হয়।এরপর গত বছরের ৪ ডিসেম্বর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) সাংবাদিকদের সামনে হাজির করে মাহবুবকে। সেই সময় ভয়ানক দিনগুলোর বর্ণনা দিয়েছিলেন মাহবুব।আজ শনিবার রাজধানীর প্যানপ্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে নিরাপদ অভিবাসন ও মানবপাচার প্রতিরোধ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিস (বায়রা) ও র্যাব যৌথভাবে এ সেমিনারের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে মানবপাচারের শিকার মাহবুবসহ ১০ জনকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়।অনুদানের চেক হাতে পাওয়ার পর মাহবুব জানান, তাঁর এই দুরবস্থার মধ্যে সরকারিভাবে এক লাখ টাকা পাওয়ায় তিনি অনেক খুশি। এই টাকা দিয়ে তিনি সংসার চালানোর একটা ব্যবস্থা করবেন। কারণ দেশে ফিরে আসার পর থেকে গ্রামের বাড়িতে জমিজমা চাষাবাদ করেই জীবন চলছে তাঁর।মাহবুব আলমের ভাই সবুজ বলেন, অনুদানের টাকা পাওয়ায় অনেক বড় উপকার হয়েছে। বিদেশ থেকে উদ্ধার হয়ে দেশে আসার পর মাহবুব দুটি গরু কিনেছেন। গ্রামের বাড়িতে তাঁদের ৫০ থেকে ৬০ শতক জমি রয়েছে। সেই জমিতে চাষাবাদের পাশাপাশি গরু লালন-পালন করেই তাঁর সংসার চলছে।সবুজ আরো বলেন, মাহবুবের সংসারে ১১ বছর ও সাত মাস বয়সী দুটি ছেলেসন্তান রয়েছে। এখন এই টাকা দিয়ে তিনি গ্রামে কিছু একটা করবেন। বিদেশে যাওয়ার আর কোনো ইচ্ছে নেই বলে মাহবুব জানিয়েছেন।
যেভাবে অপহরণের শিকার হয়েছিলেন মাহবুব
২০০৭ সালে বৈধ ভিসা নিয়েই মালয়েশিয়ায় কাজ করতে যান মাহবুব। সেখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তিনি ‘ক্লিনার’ হিসেবে কাজ করতেন। প্রায় দেড় বছর আগে সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন মাহবুব। তাঁর বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ চর আইচা গ্রামে। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। মাহবুব জানান, মালয়েশিয়ার পাহাং জেলার কুনতা থানা এলাকার একটি বাসায় তিনি ভাড়া থাকতেন। গত ২৬ নভেম্বর মাহবুব কাজ শেষ করে নিজের বাসায় ফিরে আসেন। রাত আনুমানিক ১১টার দিকে তাঁর বাসায় দুজন মালয়েশীয় ব্যক্তি এসে জানান যে তাঁরা পুলিশের লোক। তাঁদের সঙ্গে মাহবুবকে থানায় যেতে হবে। তখন মাহবুব তাঁদের সঙ্গে বাসার নিচে নেমে এসে দেখেন একটি গাড়ি দাঁড়ানো। সেই গাড়িতে তাঁকে তোলার পর তিনি গাড়ির ভেতরে আরো চারজন বাংলাদেশিকে দেখতে পান।মাহবুবকে প্রথমে একটি বনে নিয়ে দুই ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। এরপর তাঁর হাত-পা বেঁধে ওই বন থেকে অন্য একটি বনে নিয়ে যান চার বাংলাদেশি। আর পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা মাহবুবকে বনে পৌঁছে দিয়েই চলে যান। এরপর রাত দেড়টার দিকে জুলহাস নামক এক ব্যক্তি আসেন মাহবুবের কাছে। তিন লাখ টাকা দাবি করেন আর এ জন্য দেশে ফোন করতে বলেন। প্রথমে মাহবুব অস্বীকার করেন। আর এরপরই শুরু হয় মারধর। একপর্যায়ে জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে মাহবুবের হাতে ছ্যাঁকা দেওয়া হয়। তখন মাহবুবের বড় ভাই সবুজকে ফোন করেন অপহরণকারী চক্রের সদস্য জুলহাস। ফোন করে জুলহাস হুমকি দেন টাকা না দিলে তাঁর ভাইকে মালয়েশিয়ায় মেরে ফেলা হবে। তখন তাঁরা মাহবুবের সঙ্গে সবুজের কথা বলান মোবাইলে। সবুজ টাকা জোগাড় করার জন্য দুদিনের সময় চান। ফোনে ভাইকে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মাহবুব। তিনি বলতে থাকেন, ‘তোমরা ওদের টাকা দিয়ে দাও, নইলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে ভাই। আমাদের বাপ-মা কেউ কেউ বেঁচে নেই, তোমরা ছাড়া আমাকে কে বাঁচাবে। আমার বউ-ছেলেদের তোমরা দেখে রেখো।’মাহবুব আরো জানান, ওই বনে আরো ১১ জন বাংলাদেশি ছিল। তাদের অবস্থাও তাঁর মতো।
যেভাবে আটক হয় চক্রের সদস্যরা
গত বছরের ২৭ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে আলী আহমেদ রিফাত নামের এক লোক মাহবুবের ভাই সবুজকে ফোন করে বলেন বিকেলের মধ্যে টাকা দেওয়ার জন্য। নইলে মাহবুবকে মালয়েশিয়ায় মেরে ফেলা হবে। এরপর বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে মগবাজার এলাকার ইনসাফ হাসপাতালের সামনে এসে রিফাত এক লাখ টাকা নিয়ে যান। আর বাকি টাকা দ্রুত দিয়ে দেওয়ার জন্য একদিনের সময় বেঁধে দেন। এরই মধ্যে সবুজ র্যাব ৩-এ গিয়ে এ ব্যাপারে একটি লিখিত অভিযোগ করেন।
র্যাব বাকি দুই লাখ টাকা নেওয়ার জন্য অপহরণকারী দলের সদস্যদের মালিবাগ ফ্লাইওভারের নিচে আসতে বলে। সেখানে টাকা নিতে এলে দুলাল (৪০) ও রূপচাঁদ আলী (২৫) নামের দুজনকে আটক করে র্যাব। পরে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে তারা মালয়েশিয়ান পুলিশের সহায়তায় মাহবুবকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনে। আর এই ঘটনায় যুক্ত আলী আহমেদ রিফাতকেও আটক করেছে র্যাব।