ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) এর সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেছেন, শিল্পাঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা পরিবেশ উন্নয়ন, সুদের হার হ্রাস এবং নীতিমালা সংষ্কার জরুরি।
তিনি বলেন, কোভিড পরবর্তী সময় হতে আমরা নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তবে সাম্প্রতিক শিল্প-কারখানায় অসন্তোষের কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, উচ্চমূল্যস্ফীতি ও ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চ হার এবং সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার অস্থিতিশীলতার কারণে বেসরকারিখাত চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতির সার্বিক বিকাশের লক্ষ্যে যা কোন ভাবেই কাম্য নয়।
আজ শনিবার (৫ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর মতিঝিলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) কার্যালয়ে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ কথা বলেন।
আশরাফ আহমেদ বলেন, দেশের ভালো ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট রয়েছে, ফলে উদ্যোক্তারা প্রত্যাশিত মাত্রায় ঋণ পাচ্ছেন না, সেই সাথে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা শিল্পখাতে পণ্য উৎপাদনকে ব্যাহত করছে, ফলে স্থানীয় চাহিদার যোগান মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি সমন্বিত রাখা বেশ কষ্টকর হয়ে দাড়িঁয়েছে। তিনি শিল্পাঞ্চল সমূহে নিরিবিচ্ছিন্ন গ্যাস সংযোগ প্রদানের জন্য সরকারের নিকট জোর দাবী জানান।
এছাড়াও শিল্পাঞ্চল সমূহে বিশেষ করে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা স্বল্পমূল্যে নিশ্চিতকরণে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণেরও দাবী জানান।
সেমিনারের নির্ধারিত আলোচনায় এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি মীর নাসির হোসেন, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফেকচার্স অ্যান্ড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ এবং এমসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর, বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, শাশা ডেনিমস লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ডিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি শামস মাহমুদ, পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আহসান খান চৌধুরী, মাস্টারকার্ড বাংলাদেশ-এর সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল এবং ফুডপান্ডা বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আমব্রারিন রেজা অংশগ্রহণ করেন।
এফবিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ১৫% বেশি ব্যাংক ঋণের সুদ দিয়ে পৃথিবীতে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা খুবই দুঃসাধ্য একটি ব্যাপার, তবে আমাদের উদ্যোক্তাদের সেটা করতে হচ্ছে। বিশেষ করে কাস্টমস হাউসসমূহে দুর্নীতির কারণে ব্যবসায়ীরা মারাতœকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন, যেটি নিরসনে সরকার ফিন্যান্সিয়াল রিফর্মস কমিটি গঠন করার পাশাপাশি অটোমেশন নিশ্চিত করা জরুরী বলে তিনি অভিমত জানান।
তিনি বলেন, দেশে মধ্যম আয়ের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠেছে, যাদেরকে করজালের আওতায় নিয়ে আসা গেলে জিডিপিতে রাজস্বের অবদান অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে এবং লাভবান হবে আমাদের অর্থনীতি।
তিনি আরো বলেন, উচ্চ মূল্য প্রদান করেও আমাদের শিল্পখাতে প্রয়োজনীয় নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না, তাই আমাদের অনশো-অফশোর গ্যাস অনুসন্ধানে আরো জোর দিতে হবে।
এমসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, আমরা উদ্যোক্তারা এ দেশে থেকেই অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনীতিকে আরো সুদৃঢ় করতে আগ্রহী।
তিনি বলেন, দক্ষ ও ভালো নিয়োগের মাধ্যমে সংকটন উত্তরণ সম্ভব, যেটি বাংলাদেশে ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে, এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। তবে বর্তামন প্রেক্ষাপটে ব্যবসায়ীরা ভীষণভাবে অনিশ্চিয়তা ও নিরাপত্তাহীনতরা মধ্যে রয়েছে, যা উত্তরণে শিল্পাঞ্চলে বিশেষকরে শিল্প-পুলিশ ও সেনাবাহিনীর কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে, পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রেনে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।
নাসিম মঞ্জুর বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে স্থানীয়ভাবে আমাদের চাহিদা কমে গেছে, যেটা উদ্বেগের বিষয়, সেখানে সবাইকে নজর দিতে হবে। ডাবল ডিজিটের সুদ দিয়ে ব্যবসায় মুনাফা করা অসম্ভব, তাই আমাদের দীর্ঘমেয়াদী টেকসই অর্থায়ন রোডম্যাপ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উপর অধিক হারে গুরুত্বারোপ করতে হবে। শুধুমাত্র রেমিট্যান্স ও দাতাদের উপর নির্ভর করলে চলবে না, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের উপর আরো অধিক হারে গুরুত্ব দিতে হবে।
বিকেএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বিদ্যমান শ্রমিক অসন্তোষে কার্যক্রমে অনুপ্রবেশকারীদের হাত রয়েছে এবং এ অবস্থা উত্তরণে শ্রমিক-মালিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যকার সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করতে হবে।
তিনি বলেন, ইতোমধ্যে শ্রমিকদের বেশকিছু দাবী মেনে নেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি শ্রমিকদের যেকোন যৌক্তিক দাবী বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ ইতিবাচক ভাবে মেটাতে বদ্ধ পরিকর। খেলাপী ঋণ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের কারণে দেশের অধিকাংশ উদ্যোক্তাদের খেলাপী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা পুণঃবিবেচনা করা প্রয়োজন বলে তিনি অভিমত জানান, সেই সাথে শিল্পখাতে গ্যাস সরবরাহ নিরবিচ্ছিন্ন করার উপর জোর দেন তিনি।
ডিসিসিআই’র প্রাক্তন সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বিচার বিভাগ, এনবিআর এবং বাংলাদেশে ব্যাংকে কার্যক্রমে বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়েছে, যা আশাব্যঞ্জক। তবে বর্তমান সময়ে তৈরি পোশাক খাতের ঝুট ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্ব ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে শিল্প-কারখানায় নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ায় পণ্য উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, যা মোটেই কাম্য নয়, যেকোন মূল্যে এ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশ বৈশি^কভাবে ইমেজ সংকটে পড়তে পারে। এছাড়াও তিনি কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রেখে রপ্তানি সচল রাখতে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতকরণের উপর জোর দেন।
শামস মাহমুদ আরো বলেন, এলডিসি উত্তরণে আমরা এখনও প্রস্তুত নই, বিষয়টি নিয়ে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সমস্যা সমাধানে আমরা গত দুই বছরে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছি, যার প্রভাব বর্তমান সময়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং ব্যবসায়ীদের আস্থার পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষকরে শিল্পখাতের নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে মাঠপর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যেটি মোটেই কাম্য নয়, সরকারকে এ বিষয়টিতে নজর দেওয়া জরুরি। এছাড়াও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণ, এসএমইখাতে অর্থায়ন ও উন্নয়ন কার্যকর নীতি সহায়তা প্রদান একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
মাসরুর রিয়াজ আরো বলেন, ঋণপত্র খোলা সহ আর্থিকখাতের অন্যান্য সমস্যা সমাধানে রিজার্ভে আরো ৬-৮ বিলিয়ন ডলারের সংযোজন ঘটাতে হবে, সরকারকে এ ব্যাপারে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করা আবশ্যক, সেই সাথে ফরেন এক্সচেঞ্জ ও ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট সুসংহত করা জরুরি। তিনি আরো বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদের হার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা আরো ভয়াবহ হবে, তাই সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থাপনার উপর আমাদের আরো মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী বলেন, শ্রমিক অসন্তোষ, জ¦ালানি স্বল্পতা, ব্যাংক ঋণের সুদের উচ্চ হার সহ নানাবিধ সমস্যায় আমাদের বেসরকারিখাত মোকাবেলা করছে, যা দ্রুততম সময়ে উন্নতি করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের শিল্পখাতের সকল ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, অন্যথায় কর্মসংস্থানের সুযোগ হ্রাস পাবে।
মাস্টারকার্ড বাংলাদেশ-এর সৈয়দ মোহাম্মদ কামাল বলেন, চলতি বছরের জুলাই, আগস্ট মাসে ডিজিটাল পেমেন্ট কার্যক্রমে বেশ হ্রাস পেলেও সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা বেড়েছে, তবে গতমাসের বন্যা ও পাবর্ত্য এলাকায় অস্থিরতার ফলে স্থানীয় পর্যটন ব্যবসা উল্লেখজনক হারে হ্রাস পেয়েছে, সেই সাথে পাশর্^বর্তী দেশে ভিসা জটিলতার কারণেও এখাতে নেতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে ই-কমার্স খাতের উন্নয়নে আস্থার পরিবেশ উন্নতির কোন বিকল্প নেই বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। এছাড়াও বৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখতে বিদ্যমান প্রণোদনা সুবিধা অব্যাহত রাখার উপর তিনি জোর দেন, সেই সাথে একটি রোডম্যাপ প্রণয়নের দাবী জানান।
ফুডপান্ডা বাংলাদেশ’র চেয়ারম্যান এবং সিইও আমব্রারিন রেজা বলেন, গত ৩ মাসে ইন্টারনেট সেবা বিঘিœত হওয়ায় বিশেষ করে ডিজিটাল সেবা খাতের ব্যবসায়ীরা মারাতœকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং এখাতের অধিকাংশ উদ্যেক্তাই এসএমই, যাদের ব্যবসায়িক কর্মকান্ডে স্বাভাবিক করতে দ্রুততম সময়ে স্বল্পসুদে ঋণ সুবিধা প্রদান করা জরুরি। এছাড়াও সারাদেশে ডিজিটাল সেবাখাতের সম্প্রসারণে ইন্টারনেট প্রাপ্তির খরচ হ্রাস করা প্রয়োজন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
ঢাকা চেম্বারের উর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী, পরিচলনা পর্ষদের সদস্যবৃন্দ সহ সরকারি-বেসরকারিখাতের আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।