ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজের অনবদ্য সেঞ্চুরিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ওয়ানডেতে জিততে পারলো না বাংলাদেশ। ৭ উইকেটে ম্যাচ হেরেছে টাইগাররা।
সিরিজের শেষ ম্যাচ জিতে আইসিসি সুপার লিগ থেকে ১০ পয়েন্ট পাওয়া, আফগানিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করা ও আইসিসি ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে ষষ্ঠস্থানে উঠার স্বপ্ন ছিলো বাংলাদেশের। কিন্তু শেষ ওয়ানডে হেরে তিন স্বপ্নই ভঙ্গ হলো তামিম ইকবালের দলের।
তবে আফগানিস্তানের বিপক্ষে প্রথম দুই ওয়ানডে জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতলো বাংলাদেশ।
আইসিসি সুপার লিগে ১৫ ম্যাচ খেলে ১০ জয় ও ৫ হারে ১০০ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের শীর্ষেই থাকলো বাংলাদেশ। আর শেষ ম্যাচ জিতে ১০ পয়েন্ট পাওয়ায় সুপার লিগের টেবিলের সপ্তম থেকে চতুর্থস্থানে উঠলো আফগানিস্তান। ৯ ম্যাচে ৭ জয় ও ২ হারে ৭০ পয়েন্ট আফগানদের। ১৫ ম্যাচে ইংল্যান্ড ৯৫ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় ও ১২ ম্যাচে ৭৯ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের তৃতীয়স্থানে ভারত।
আফগানিস্তানকে হোয়াইটওয়াশের লক্ষ্য নিয়ে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে এ ম্যাচেও টস জিতে প্রথমে ব্যাট করার সিদ্বান্ত নেন বাংলাদেশ অধিনায়ক তামিম ইকবাল।
আগের দুই ম্যাচের ন্যায় আজও আফগানিস্তানের বাঁ-হাতি পেসার ফজল হক ফারুকির বলে আউট হন তামিম। ২৫ বলে ১টি চারে ১১ রান করেন তামিম।
ওপেনিংয়ে সতীর্থ লিটনের সাথে ১০ দশমিক ১ ওভারে চলতি সিরিজে সর্বোচ্চ ৪৩ রানের জুটি গড়ে বিদায় নেন তামিম।
অধিনায়কের বিদায়ে উইকেটে আসেন সাকিব আল হাসান। লিটনের সাথে তাল মিলিয়ে রানের চাকা ঘুড়িয়েছেন তিনি। ২০তম ওভারে নিজের ৫০তম ওয়ানডেতে হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন লিটন। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ হাফ-সেঞ্চুরি পেতে ৬৩ বল খেলেছেন আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করা লিটন। হাফ-সেঞ্চুরিতে পা দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪ হাজার রান পূর্ণ করেন লিটন।
পরের ওভারে জুটিতে হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন লিটন-সাকিব। আর পরের ওভারে লিটন-সাকিব জুটি ভাঙ্গেন আফগানিস্তানের ডান-হাতি পেসার আজমতুল্লাহ ওমারজাই। দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে সাকিবকে বোল্ড করেন ওমারজাই। ৩টি চারে ৩৬ বলে ৩০ রান করে ফিরেন উইকেটে সেট ব্যাটার সাকিব। দ্বিতীয় উইকেটে ৬৯ বলে ৬১ রান যোগ করেন লিটন-সাকিব।
সাকিবের উইকেট পতনে, বিপদ বাড়ে বাংলাদেশের। ৪ রানের ব্যবধানে বাংলাদেশের দুই মিডল-অর্ডার ব্যাটার মুশফিকুর রহিম ও ইয়াসির আলিকে শিকার করেন আফগানিস্তানের স্পিনার রশিদ খান। উইকেটের পেছনে রহমানউল্লাহ গুরবাজকে ক্যাচ দেন ১৫ বলে ৭ রান করা মুশফিক। আর রশিদের ষষ্ঠ ওভারের শেষ বলে স্লিপে গুলবাদিন নাইবকে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন ৪ বলে ১ রান করা ইয়াসির।
ইয়াসিরকে আউট হরে ৮০তম ওয়ানডেতে ১৫০তম শিকার পূর্ণ করেন রশিদ। দ্রুত ১৫০ উইকেট শিকারের তালিকায় তৃতীয়স্থানে জায়গা করে নেন রশিদ। ওয়ানডেতে দ্রুত ১৫০ উইকেট শিকারের রেকর্ড অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্কের। ৭৭ ম্যাচে ১৫০ উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়েছেন স্টার্ক।
মুশফিক-ইয়াসিরের আউটের মাঝে নিজের ইনিংস বড় করছিলেন লিটন। আরও একটি সেঞ্চুরির স্বপ্নও বুনে ফেলেছিলেন তিনি। কিন্তু ৩৬তম ওভারে মোহাম্মদ নবির বল স্লগ সুইপ করতে গিয়ে বল আকাশে তুলে দেন লিটন। লং অন থেকে দে(ৗড়ে দারুন ক্যাচ নেন নাইব। ফলে ১১৩ বলে ৭টি চারে গড়া ৮৬ রানের ইনিংসের সমাপ্তি ঘটে লিটনের।
দলীয় ১৫৩ রানে পঞ্চম ব্যাটার হিসেবে আউট হন লিটন। এরপর আফগানিস্তানের বোলারদের দৃঢ়তায় ও নিজেদের ভুলে বাকী ৫ উইকেট ৩৯ রানের ব্যবধানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। ৪৬ দশমিক ৫ ওভারে ১৯২ রানে অলআউট হয় টাইগাররা।
অফ-স্টাম্পের বল পুল করতে গিয়ে মিড-অনে মুজিব উর রহমানকে ক্যাচ দেন প্রথম ম্যাচের হিরো আফিফ হোসেন। ৬ বলে ১টি চারে ৫ রান করেন তিনি। মাহমুদুল্লাহর সাথে ভুল বুঝাবুঝিতে রান আউট হন প্রথম ম্যাচের সেরা মেহেদি হাসান মিরাজ। ১২ বলে ৬ রান করেন তিনি।
আর লোয়ার-অর্ডারে পেসার তাসকিন আহমেদকে খালি হাতে বিদায় দেন রশিদ। লেগ বিফোর হন তাসকিন। আর শেষ দুই ব্যাটার শরিফুল ইসলাম ৭ ও মুস্তাফিজুর রহমান ১ রান করে রান আউট হন। অন্যপ্রান্তে দলের সতীর্থদের যাওয়া আসা দেখেন মাহমুদুল্লাহ। শেষ পর্য়ন্ত ৫৩ বলে কোন বাউন্ডারি ছাড়া ২৯ রানে অপরাজিত থেকে যান তিনি।
আফগানিস্তানের রশিদ ৩৭ রানে ৩টি ও নবি ২৯ রানে ২টি উইকেট নেন।
হোয়াইটওয়াশ এড়াতে ১৯৩ রানের লক্ষে খেলতে নেমে সাবধান শুরু ছিলো আফগান দুই ওপেনার রহমানউল্লাহ গুরবাজ ও রিয়াজ হাসানের। প্রথম ৬ ওভারে মাত্র ২০ রান তুলেন তারা। বাংলাদেশের পেসার শরিফুল ইসলামের করা সপ্তম ওভার থেকে ১৩ রান তুলেন গুরবাজ ও রিয়াজ।
তাসকিনের পরের ওভারে ৩টি চার মারেন রিয়াজ। ১০ ওভার শেষে ৫৭ ও ১৫ ওভার শেষে আফগানদের রান গিয়ে দাঁড়ায় ৭৯। এই জুটি ভাঙ্গতে চার বোলার ব্যবহার করেছিলেন টাইগার নেতা তামিম।
অবশেষে ১৬তম ওভারে সাকিবের হাত ধরে প্রথম সাফল্য দেখে বাংলাদেশ। স্টাম্পড আউট হওয়ার আগে ৪টি চার ও ১টি ছক্কায় ৩৫ রান করেন রিয়াজ।
দলীয় ৭৯ রানে রিয়াজের আউটের পর ক্রিজে গুরবাজের সঙ্গী হন রহমত শাহ। ১৮তম ওভারে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান ইতোমধ্যে এই ফরম্যাটে দু’টি সেঞ্চুরি করা গুরবাজ। ৫৩ বলে হাফ-সেঞ্চুরি করার পর দলের জয়ের ভিত গড়েন গুরবাজ। তাকে সঙ্গ দেন রহমত।
সাকিবকে মাথার উপর দিয়ে ছক্কা মেরে ২৩তম ওভারে আফগানিস্তানের রান ১শতে পৌঁছে দেন গুরবাজ। পরের ওভারে শরিফুলের পঞ্চম ওভারের চতুর্থ বলে উইকেটের পেছনে মুশফিকের হাতে জীবন পান গুরবাজ। তখন তার রান ৬০ ছিলো।
শরিফুলের পরের ও ২৫তম ওভারে লং লেগে গুরবাজের ক্যাচ ফেলেন মাহমুদুল্লাহ। তখন ৬১ রানে ছিলেন গুরবাজ।
দু’বার জীবন পেয়ে আর পেছন ফিরে তাকাননি গুরবাজ। শরিফুলের সপ্তম ওভারে ১টি করে চার-ছক্কা মারেন তিনি। মিরাজকে লং-অফ দিয়েও ছক্কা মেরেছিলেন তিনি।
৩৬তম ওভারে গুরবাজ-রহমতের জুটি ভাঙ্গেন মিরাজ। ৩টি চারে ৬৭ বলে ৪৭ রান করা রহমতকে স্টাম্পড আউট করেন মিরাজ। দ্বিতীয় উইকেটে গুরবাজ-রহমত ১২৩ বলে ১০০ রানের জুটি গড়েন। এতে জয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায় আফগানিস্তান।
রহমত যখন ফিরেন তখন জয় থেকে ১৪ রান দূরে ছিলো আফগানিস্তান। আর ক্যারিয়ারের তৃতীয় সেঞ্চুরির জন্য ৪ রান দরকার ছিলো গুরবাজের।
আফগানিস্তানের অধিনায়ক হাসমতউল্লাহ শাহিদিকে লেগ বিফোর আউট করেন মিরাজ। ২ রান করেন শাহিদি। তবে ৩৯তম ওভারে ঠিকই ৯ ম্যাচের ক্যারিয়ারে তৃতীয় সেঞ্চুরি তুলে নেন গুরবাজ। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে নিজের অভিষেক ওয়ানডেতেই সেঞ্চুরি করেছিলেন গুরবাজ। আবু ধাবির মাঠে ঐ ম্যাচে আফগানদের প্রতিপক্ষ ছিলো আয়ারল্যান্ড। একই মাসে দোহাতে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় সেঞ্চুরির দেখা পান গুরবাজ।
সেঞ্চুরির পর ৪১তম ওভারের প্রথম বলে ১ রান নিয়ে আফগানিস্তানের জয় নিশ্চিত করেন গুরবাজ। ১১০ বলে ৭টি চার ও ৪টি ছক্কায় ১০৬ রানে অপরাজিত থাকেন তিনি। ১ রানে অপরাজিত ছিলেন নাজিবুল্লাহ জাদরান। বাংলাদেশের মিরাজ ৩৭ রানে ২টি ও সাকিব ৪৭ রানে ১টি উইকেট নেন।
ওয়ানডে শেষে এবার দুই ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলবে বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান। ৩ ও ৫ মার্চ মিরপুরে হবে ঐ দু’টি টি-টোয়েন্টি।
স্কোর কার্ড : (টস-বাংলাদেশ)
বাংলাদেশ ইনিংস :
তামিম ইকবাল বোল্ড ব ফারুকি ১১
লিটন দাস ক নাইব ব নবি ৮৬
সাকিব আল হাসান বোল্ড ব ওমারজাই ৩০
মুশফিকুর রহিম ক গুরবাজ ব রশিদ ৭
ইয়াসির আলি ক নাইব ব রশিদ ১
মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ অপরাজিত ২৯
আফিফ হোসেন ক মুজিব ব নবি ৫
মেহেদি হাসান মিরাজ রান আউট (জাদরান) ৬
তাসকিন আহমেদ এলবিডব্লু ব রশিদ ০
শরিফুল ইসলাম রান আউট (মুজিব) ৭
মুস্তাফিজুর রহমান (গুরবাজ) ১
অতিরিক্ত (বা-১, লে বা-১, ও-৭) ৯
মোট (অলআউট, ৪৬.৫ ওভার) ১৯২
উইকেট পতন : ১/৪৩ (তামিম), ২/১০৪ (সাকিব), ৩/১২১ (মুশফিক), ৪/১২৫ (ইয়াসির), ৫/১৫৩ (লিটন), ৬/১৬০ (আফিফ), ৭/১৭৫ (মিরাজ), ৮/১৭৬ (তাসকিন), ৯/১৮৯ (শরিফুল), ১০/১৯২ (মুস্তাফিজ)।
আফগানিস্তান বোলিং :
ফজলহক ফারুকি : ৭.৫-০-৩৩-১ (ও-২),
মুজিব উর রহমান : ৮-০-৩৭-০ (ও-২),
আজমতুল্লাহ ওমারজাই : ৬-০-২৯-১ (ও-১),
গুলবাদিন নাইব : ৫-০-২৫-০ (ও-১),
রশিদ খান : ১০-০-৩৭-৩ (ও-১),
মোহাম্মদ নবি : ১০-০-২৯-২।
আফগানিস্তান ইনিংস :
রহমানুল্লাহ গুরবাজ অপরাজিত ১০৬
রিয়াজ হাসান স্টাম্প মুশফিক ব সাকিব ৩৫
রহমত শাহ স্টাম্প মুশফিক ব মিরাজ ৪৭
হাসমতুল্লাহ শাহিদি এলবিডব্লু ব মিরাজ ২
নাজিবুল্লাহ জাদরান অপরাজিত ১
অতিরিক্ত (ও-২) ২
মোট (৩ উইকেট, ৪০.১ ওভার) ১৯৩
উইকেট পতন : ১/৭৯ (রিয়াজ), ২/১৭৯ (রহমত), ৩/১৮৩ (শাহিদি)।
বাংলাদেশ বোলিং :
শরিফুল ইসলাম : ৭-১-৪১-০,
তাসকিন আহমেদ : ৬-০-৩৪-০,
সাকিব আল হাসান : ১০-০-৪৭-১,
মুস্তাফিজুর রহমান : ৬-০-২৪-০ (ও-২),
মেহেদি হাসান মিরাজ : ৮.১-১-৩৭-২,
আফিফ হোসেন : ২-০-৮-০।
ফল : আফগানিস্তান ৭ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : রহমানউল্লাহ গুরবাজ
সিরিজ : তিন ম্যাচের সিরিজ ২-১ ব্যবধানে জিতলো বাংলাদেশ।