বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার আয়তন মোট ৬৬৪ কিলোমিটার, কিন্তু মাছ আহরণ করা হয় মাত্র ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে। আর তাই মাছের বৈশ্বিক উৎপাদনে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ। যেখানে চীন একাই বিশ্ববাসীকে ৬১ শতাংশ মাছের যোগান দিচ্ছে। একই ভাবে সাগরের সীমানায় মালিকানা প্রতিষ্ঠা হলেও, এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে সমুদ্র বক্ষের বিপুল পরিমাণ তেল ও গ্যাস।
শুধু মাছ কিংবা খনিজ সম্পদ নয়, নিজেদের সীমানার সাগরকে ব্যবহার করে পাল্টে দেয়া যেতে পারে বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতির চিত্র। সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে পর্যটন, জাহাজ শিল্প, গভীর সাগরে মাছ ধরার উপযোগি জাহাজ নির্মাণ, কনটেইনার, ওষুধ, প্রসাধনীসহ নানা শিল্প বিকশিত হতে পারে। এর জন্য দরকার সঠিক কর্ম-পরিকল্পনা ও তার যথার্থ বাস্তবায়ন।
রোববার রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক কর্মশালায় মূল প্রবন্ধে এসব তুলে ধরেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম।
এফবিসিসিআই ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) যৌথভাবে কর্মশালার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও বিশেষ অতিথি ছিলেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম। স্বাগত বক্তব্য দেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
খুরশেদ আলম বলেন, বাংলাদেশের যে সমুদ্রসীমা আছে তা মূল ভূখন্ডের ৮১ ভাগের সমান। পুরো বিশ্বে আন্তর্জাতিক সমুদ্রপথে দেড় লাখ জাহাজ চলাচল করে, সেখানে বাংলাদেশের জাহাজ মাত্র ৭০টি। অথচ এই পথে পণ্য পরিবহনের অর্থনীতির আকার ৯’শ কোটি ডলার। এছাড়াও কনটেইনার নির্মাণেও বাংলাদেশের সম্ভাবনা রয়েছে। ৭৪ শতাংশ কনটেইনার ব্যবহার হয় এশিয়া অঞ্চলে। প্রতিবছর ১৫ শতাংশ হারে বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে কনটেইনারের চাহিদা আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সমুদ্র বন্দর থাকলেও, তা মাদার ভেসেলের জন্য উপযোগী নয়। এমন অবস্থায় মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মিত হলে তা সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সহায়তা করবে।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেন, সুনীল অর্থনীতি বাংলাদেশে বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনাময় খাত। এ খাত থেকে আগামী কয়েক বছরেই ১’শ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করা সম্ভব।
তিনি বাংলাদেশের এক সময়ের উদীয়মান খাত জাহাজ শিল্পের অগ্রগতি কেন ধীর হয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে ও নীতি কৌশল ঠিক করতে এফবিসিসিআই ও বিডাকে একসাথে কাজ করার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, এছাড়া গভীর সমুদ্রের উপযোগী মাছ ধরার ট্রলার বা জাহাজ নির্মাণে দেশী বিদেশী যৌথ মালিকানায় উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এ সংক্রান্ত নীতির সংশোধন জরুরি বলে তিনি উল্লেখ করেন।
কর্মশালায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম বলেন, সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনার সাথে সাথে এই সম্পদ সংরক্ষণের নীতিও গ্রহণ করতে হবে। সরকারের নেয়া নদী ভাঙন প্রতিরোধ কর্মসূচির কারণে উপকুলীয় এলাকায় মানুষ এই বিপর্যয়ের হাত থেকে এখন অনেকটাই মুক্ত বলে জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, আগামী ২৮-২৯ নভেম্বরে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। ওই সম্মেলনে ব্লু-ইকোনমি নিয়ে আলাদা আলোচনা করা হবে।
অনুষ্ঠানে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, এলডিসি পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ ও কর্মসংস্থান তৈরিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সমুদ্র অর্থনীতি। কর্মশালায় আলোচিত বিষয়গুলোর সমন্বয়ে এ খাতের কর্মকৌশল নির্ধারণে সরকারের কাছে সুপারিশ জমা দেবে এফবিসিসিআই।
কর্মশালায় প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির গবেষণা পরিচালক ও এফবিসিসিআইয়ের প্যানেল উপদেষ্টা ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ব্লু-ইকোনমির সম্ভাবনা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। কিন্তু এখনো কোন পরিকল্পনা নেই। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় যার যার মতো কাজ না করে, বিডা নিজে তত্ত্বাবধান করলে, দ্রুত সুফল পাওয়া যেতে পারে।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও এফবিসিসিআইয়ের প্যানেল উপদেষ্টা ড. এ.কে. এনামুল হক বলেন, আগামী ১০ থেকে ২০ বছরে বিশ্বের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হবে সমুদ্রকেন্দ্রিক। ব্লু-ইকোনমিকে কাজে লাগাতে পর্যটন, জাহাজ নির্মাণ, জাহাজ ভাঙা, ফিশিং, বন্দর, মেরিটাইম ইক্যুইপমেন্ট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি। তিনি এক্ষেত্রে বিদেশী ও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে নীতি বৈষম্য দূর করার তাগিদ দেন ।
কর্মশালায় অন্যান্যের মধ্যে এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু, সহ-সভাপতি এম এ মোমেন, মো. আমিনুল হক শামীম, মো. আমিন হেলালী, সালাহউদ্দিন আলমগীর ও মো. হাবীব উল্লাহ ডন প্রমূখ উপস্থিত ছিলেন।