সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের নাজুক পরিস্থিতিতে সবাইকে সর্বোচ্চ সতর্কতা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, লকডাউনের সুফল শতভাগ পেতে হলে সরকারের নির্দেশিত বিধি-নিষেধ পুরোপুরি মেনে চলতে হবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরো বলেছেন, গেল ঈদুল ফিতরের সময় সরকারের বারংবার সতর্কবার্তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। বহু মানুষ গ্রামের বাড়িতে ছুটে গেছেন স্বজনদের সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য। ফলে ঈদের পরপরই সংক্রমণ হু হু করে বেড়েছে এবং এ ধারা এখনো চলছে। অন্যদিকে, গ্রামেও করোনাভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে। অথচ, এর আগে গ্রামে খুবই সীমিত সংখ্যক আক্রান্ত পাওয়া যেতো।
তারা বলেন, বর্তমানে করোনাভাইরাসের আগ্রাসী রূপ দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় আসন্ন ঈদুল আজহার সময়ে মানুষের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যথায় অবস্থা বেসামাল হয়ে পড়বে। চিকিৎসা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। তাই জনসচেতনতার পাশাপশি স্বাস্থ্যবিধি ও লকডাউনের বিধি-নিষেধ কঠোরভাবে প্রতিপালনের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে সক্রিয় হতে হবে।
জানা যায়, গত বছর ৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর গতকালই একদিনে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ধরা পড়ে। সংক্রমণের হারও সর্বোচ্চ ৩৫ দশমিক ০২ শতাংশ। একদিন আগে ৫৫৯ জন ভাইরাসবাহক শনাক্ত হন, যা ছিল তখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। গতকাল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ জন মারা যান করোনা সংক্রান্ত জটিলতায়। ১০ এপ্রিলও ৯ রোগীর মৃত্যু হয়। ২৪ এপ্রিল করোনায় সর্বোচ্চ ১১ জনের মৃত্যু হয়। তবে এদিন ১৭১ জন নতুন বাহক শনাক্ত হন। সংক্রমণ হার ছিল ১২ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
এদিকে, এবার মাত্র দুই দিনে আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার পূর্ণ হয়েছে। এর আগে, ৩ জুলাই তিন দিনে সংক্রমিত এক হাজার পূর্ণ হয়ে মোট সংখ্যা ৬০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ৩০ জুন দুই দিনে সংক্রমিতের সংখ্যা এক হাজার পূর্ণ হয়েছিল। দুই দিনে এক হাজার পূর্ণ হয় আরো একবার ১৪ এপ্রিল, মোট আক্রান্ত ৪৬ হাজার অতিক্রম করাকালে। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ১৬ দিনে ১ হাজার পূর্ণ হয়ে ৩৩ হাজার অতিক্রম করে ৩১ জানুয়ারি।
উপরোল্লিখিত তথ্য বিশ্লেষণে করোনার ভয়ংকর চিত্র ফুটে ওঠে। এ অবস্থায় সমাজের সচেতন অংশের পাশাপাশি খোদ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরাই শঙ্কিত।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি আজ বাসস’কে বলেন, ‘অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন করোনা পরিস্থিতি খারাপ। সরকারের উদ্যোগের সাথে সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। চলমান লকডাউনের মধ্যে আরোপিত বিধি-নিষেধ পুরোপুরি মানতে হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লকডাউনের সুফল আমরা দেখেছি। যারা মেনেছেন তারা আজ অনেকটা মুক্ত জীবন-যাপন করতে পারছেন। তাদের জীবন-জীবিকাও নিরাপদে চলছে। আমাদেরও এ পথ অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই।’
সিভিল সার্জন বলেন, ‘লকডাউনের ৫ দিন অতিবাহিত হয়েছে। ৮ থেকে ১০ দিন পর আমরা রেজাল্ট পাবো বলে আশা করি। তবে মানুষের বেপরোয়া চলাফেরায় লকডাউন অকার্যকর হয়ে গেলে সুফল তো মিলবে না, উপরন্তু সামনে আরো কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হবে। মহানগরীতে এবং উপজেলা সদরে বিধি-নিষেধ কিছুটা মানার প্রবণতা দেখা গেলেও অলিগলি ও হাট-বাজারের জটলা এখনও আছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে এদিকে একটু নজর দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন গ্রামে প্রচুর আক্রান্ত হচ্ছে। নি¤œবিত্ত শ্রেণীর মধ্যেও সংক্রমণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যা এতদিন দেখা যায়নি। তবে, বেশিরভাগ মানুষ স্বাস্থ্য বাতায়ন অথবা অন্যান্য টেলি-মেডিসিনের মাধ্যমে ঘরে চিকিৎসা নিচ্ছেন।’
নগরীর অনন্যা আবাসিকে নতুন করে চালু হওয়া এভারকেয়ার হাসপাতালের মেডিসিন, কোভিড ও আইসিইউ’র প্রধান, সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. এএম রায়হান উদ্দিন বলেন, ‘ঈদুল ফিতরের সময় সরকারের পরামর্শ না মানার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। আসন্ন ঈদুল আজহায় এটা কোনোভাবেই হতে দেয়া যাবে না। লকডাউন বা অন্য যেকোনো উপায়ে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। জনসমাগম বা জটলা তৈরি হতে যেন না পারে সে ব্যাপোরে সর্বোচ্চ সচেষ্ট হতে হবে। করোনার সংক্রমণ আর বাড়লে বিপর্যয় নেমে আসবে সব দিক থেকে। আমি বিশ^াস করি, ঈদুল আজহার সময়টা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে পার করা গেলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে করোনা পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
ডা. রায়হান সদ্য চালু এভারকেয়ার হাসপাতাল প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের এখানে কোভিডের জন্য বর্তমানে ডেডিকেটেড পাঁচটি আইসিইউ, পাঁচটি এইচডিইউ, ২০ টি আইসোলেশন বেড ও ১২ টি হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা রয়েছে। আজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বৈঠকে কোভিডের আরো চিকিৎসা সেবা ও সুবিধা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
সদরঘাটস্থ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন জেনারেল হাসপাতালের ইনচার্জ ডা. দীপা ত্রিপুরা বলেন, ‘করোনার বর্তমান পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট এর অন্যতম কারণ হতে পারে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত এক করোনা রোগী নূন্যতম আট জনের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটায়। পরিবারের একজন আক্রান্ত হলে অন্য সদস্যরাও সংক্রমিত হয়ে পড়ে। আক্রান্তের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর শারীরিক অবস্থা নাজুক হয়ে যায়। এ অবস্থা আমরা গত বছর প্রথম প্রকোপের সময় দেখিনি।’
তিনি বলেন, ‘যেহেতু বর্তমান ভাইরাসটি অনেক বেশি প্রাণঘাতী তাই আমাদেরকেও অনেক বেশি সতর্কভাবে এটাকে মোকাবেলা করতে হবে। বাইরে গেলেই মুখে মাস্ক রাখা, বারেবারে হাত ধোয়াসহ স্বাস্থ্যবিধির প্রতিটি নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালনের মাধ্যমে বর্তমান করোনার প্রকোপ থেকে নিজে এবং ঘনিষ্ঠ স্বজনদের রক্ষা করতে হবে।’