বিশ্বকাপের আগে ইউরোপীয়ান হেভিওয়েট সবগুলো দলই ফর্ম ও ফিটনেস নিয়ে দু:শ্চিন্তায় রয়েছে। আর এই সুযোগে দক্ষিন আমেরিকান জায়ান্ট ব্রাজিল রেকর্ড ষষ্ঠবারের মত বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তোলার লক্ষ্যে সুস্পষ্ট ফেবারিট হয়ে উঠেছে।
অতীতে কি হয়েছে তা এখন অনেকাংশেই অপ্রাসঙ্গিক। বিশেষ করে প্রথমবারের মত মধ্যপ্রাচ্যে বিশ্বকাপ আয়োজনের পাশাপাশি সময় পরিবর্তিত হয়ে প্রথমবারের মত নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিশ্ব ফুটবলের সর্বোচ্চ এই আসর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাই বিশ্বকাপ ঘিড়ে এবারের আকর্ষনটা একটু হলেও ভিন্ন। ইতিহাস বলে ব্রাজিলের শেষ চারটি বিশ্বকাপ শিরোপাই এসেছিল ইউরোপের বাইরে থেকে। ২০১৪ সালে ঘরের মাঠের চাপ নিতে না পেরে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার চার বছর পর রাশিয়ায় আগোছালো ফুটবল ব্রাজিল খেলেছিল, আর এবার তারা সবচেয়ে শক্তিশালী ও ফর্মের তুঙ্গে থাকা আত্মবিশ্বাসী এক দল হিসেবে কাতারে যাচ্ছে।
এবারের দলটি শুধুমাত্র আর নেইমারের উপর নির্ভরশীল নয়। যদিও ব্রাজিল যখনই মাঠে নামবে আকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দুতে পিএসজির এই তারকাই থাকবেন। তারপরও তিতের দল যে নিজেদের যোগ্যতা দিয়েই ফেবারিট হিসেবে মাঠে নামতে যাচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। গোলবারে আলিসন থেকে শুরু করে মধ্যমাঠে ফাবিনহো, কাসেমিরো, আক্রমনভাগে ভিনিসিয়াস জুনিয়র, রবার্তো ফিরমিনো রিচারলিসনরা রয়েছে ফর্মের তুঙ্গে।
সেলেসাও কিংবদন্তী কাফু সম্প্রতি গ্লোবস্পোর্টসকে বলেছেন, ‘ব্রাজিল বর্তমানে অনেক বেশী পরিনত ও অভিজ্ঞ। তাদের প্রস্তুতিও দুর্দান্ত হয়েছে। তারা এখন আর একজন খেলোয়াড়ের উপর নির্ভর করে না। আমরা এমন একটি দল যেখানে প্রতিটি পজিশনে প্রতিটি খেলোয়াড়ই যোগ্য। আমি মনে করি ব্রাজিলের এবারের দলটি অন্য যেকোন সময়ের তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী। তাদের এবার বিশ্বকাপ জয়ের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে।’
তবে একটি প্রশ্ন ব্রাজিল দলকে ঘিড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে যা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ২০১৮ বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে পরাজিত হয়ে বিদায় নেবার পর এই চার বছরে ইউরোপীয়ান শীর্ষ সারির কোন দলের বিপক্ষে মাঠে নামেনি তিতের শিষ্যরা।
এদিকে ব্রাজিলের দক্ষিণ আমেরিকান চির প্রতিদ্বন্দ্বী আর্জেন্টিনাকেও এগিয়ে রাখা যেতেই পারে। বছরের শুরুতে উয়েফা ফিনালিসিমায় লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ইতালিকে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল আর্জেন্টিনা। দুইবারের বিশ^কাপ জয়ী আর্জেন্টিনা কাতারের টিকিটও পেয়েছে বেশ দাপটের সাথেই। ২০১৯ সালে সর্বশেষ কোপা আমেরিকায় ব্রাজিলের কাছে পরাজিত হবার পর এ পর্যন্ত টানা ৩৫ ম্যাচে অপরাজিত আছে লিওনেল মেসির নেতৃতাধীন আর্জেন্টাইনরা। বর্তমানে বিশ^ র্যাঙ্কিংয়ে তৃতীয় স্থানে থাকা আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনি অবশ্য ব্রাজিলের মত শক্তিশালী দল কাতারে পাচ্ছেন না। শেষ তিনটি ম্যাচে দেশের হয়ে ৯ গোল করা মেসির উপর এক্ষেত্রে পুরো নির্ভরশীলতা আরো একবার থাকতেই পারে। বার্সেলোনার ৩৫ বছর বয়সী সাবেক এই তারকার এবারই বিশ^কাপ জয়ের শেষ সুযোগ। আর এই মানসিকতকাই আর্জেন্টিনাকে টুর্নামেন্টে এগিয়ে নিতে যেতে পারে।
মেসি নিজেও তা স্বীকার করেছেন, ‘এটাই আমার শেষ বিশ^কাপ। আমরা একটি ঐক্যবদ্ধ দল হিসেবে শক্তিশালী স্কোয়াড নিয়ে বিশ^কাপে খেলতে যাচ্ছি। কিন্তু এই ধরনের বড় টুর্নামেন্টে সব কিছুই সম্ভব। এখানে প্রতিটি ম্যাচই বেশ কঠিন। আর এখানে সবসময় ফেবারিটটা জিতে না।’
২০০২ সালের ফ্রান্স দলটির দিকে তাকালে এর উৎকৃষ্ট উদাহরন স্পষ্ট হয়ে উঠবে। ঐ টুর্ণামেন্টে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ও একইসাথে ইউরোপীয়ান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ফেবারিট হিসেবে মাঠে নেমেছিল ইনজুরি আক্রান্ত জিনেদিন জিদানের নেতৃত্বে ফ্রান্স। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ান আসরে গ্রুপ পর্ব থেকেই ফ্রান্সকে বিদায় নিতে হয়েছিল। দুই দশক থেকে লেস ব্লুজরা আবারো বর্তমান চ্যাম্পিয়ন হিসেবে কাতারে খেলতে নামছে, কিন্তু দিদিয়ের দেশ্যমের দলের সব কিছু এখন সঠিক পথে নেই। দলের অন্যতম মূল তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে পিএসজি ছাড়া না ছাড়া নিয়ে দোটানায় থাকায় কিছুটা হলেও আত্মবিশ^াস হারিয়েছেন। এছাড়া ইনজুরি একটি বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে। চার বছর আগে রাশিয়া বিশ^কাপে শিরোপা জয়ে অন্যতম অবদান রাখা মিডফিল্ডার এন’গোলো কান্তে হাঁটুর ইনজুরিতে ছিটকে পড়েছেন। যদিও ব্যালন ডি’অরের নতুন রাজা করিম বেনজেমাকে নিয়ে দেশ্যম স্বস্তিতে থাকতেই পারেন। রাশিয়া বিশ^কাপে না খেলা বেনজেমা এবার ফর্মের তুঙ্গে থেকেই কাতারে খেলতে যাবেন।
ফ্রান্স অন্তত বিশ^কাপের মূল পর্বে তো খেলছে, কিন্তু ইউরো জয়ী আরেক ইউরোপীয়ান জায়ান্ট ইতালি টানা দ্বিতীয়বারের মত বিশ^মঞ্চে না খেলার দূর্ভাগ্য বয়ে বেড়াচ্ছে।
অন্যদিকে ইংল্যান্ড শিবিরে রয়েছে ফর্মহীনতার দু:শ্চিন্তা। নেশন্স লিগে আগোছালো পারফর্ম করা ইংল্যান্ড টানা ছয় ম্যাচে জয়বিহনী থেকে বিশ^কাপে মাঠে নামবে। ইনজুরির কারনে দলের সেরা রাইট-ব্যাক রেসি জেমস ইতোমধ্যেই বিশ^কাপ থেকে ছিটকে গেছেন।
জার্মানীকে নিয়েই কোন সুখবর পাবার আশা নেই বললেই চলে। ইউরোর শেষ ১৬ থেকে বিদায় নেয়া জার্মান দলের কোচ হিসেবে জোয়াকিম লোয়ের স্থানে ইতোমধ্যেই হান্সি ফ্লিক দায়িত্ব নিলেও কাতারে দলের সাফল্য নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
আবারো বিশ^কাপে ফিরে আসা সত্বেও নেদারল্যান্ডও নিজেদের এগিয়ে রাখতে পারছেনা, বেলজিয়ামকে নিয়েও সম্ভাবনার আশা খুবই ক্ষীন। ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর ফর্মহীনতায় দলের তরুণ এ্যাটাকারদের দিয়ে এবার চমক দেখাতে পারে পর্তুগাল। স্পেনকে নিয়ে অবশ্য কিছুটা হলেও আশার কথা শোনা গেছে। দলের তরুণদের উপরই এবার মূল ভরসা রাখছে স্প্যানিশরা। ২০১৮ সালের সারপ্রাইজ প্যাকেজ আরেক ইউরোপীয়ান দল ক্রোয়েশিয়া, ডেনমার্কের দিকে এবারও দৃষ্টি থাকবে। এই তালিকায় সার্বিয়াও রয়েছে।
সাদিও মানের আফ্রিকান নেশন্স কাপ বিজয়ী সেনেগালও হতে পারে সকলের আর্কষনের কেন্দ্রবিন্দুতে।
ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা তাদের নিজ নিজ গ্রুপে বিজয়ী হয়ে নক আউট পর্বে উঠতে পারলে সব ঠিক থাকলে সেমিফাইনালেই দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বীর দেখা হতে পারে।