দুই ব্যাটার ইনোসেন্ট কাইয়া ও সিকান্দার রাজার জোড়া সেঞ্চুরিতে জিম্বাবুয়ের কাছে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচে অসহায়ভাবে হারলো সফরকারী বাংলাদেশ।
আজ হারারে স্পোর্টস ক্লাব মাঠে কাইয়ার ১১০ ও রাজার অপরাজিত ১৩৫ রানের উপর ভর করে জিম্বাবুয়ে ৫ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশকে। এতে নয় বছর ও ১৯ ম্যাচ পর জিম্বাবুয়ে কাছে হার বরণ করলো তামিম ইকবালের দল। ২০১৩ সালের মে’তে বুলাওয়েতে সর্বশেষ জিম্বাবুয়ের কাছে ৭ উইকেটে হেরেছিলো বাংলাদেশ। এই জয়ে তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে গেল স্বাগতিক জিম্বাবুয়ে।
টি-টোয়েন্টি সিরিজের তিন ম্যাচের মত প্রথম ওয়ানডেতেও টস ভাগ্যে জয় পায় জিম্বাবুয়ে। লিটন দাসকে নিয়ে ইনিংস শুরু করেন অধিনায়ক তামিম ইকবাল। সাবধানী শুরু ছিলো দুই ওপেনারের। ১০ ওভারে ৫১ ও ২০ ওভারে ৮৯ রান তুলেন তারা। ২৩তম ওভারে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৫৪তম হাফ সেঞ্চুরি তুলে নেন তামিম। এজন্য ৭৯ বল খেলেন তিনি। পরের ওভারের পঞ্চম বলে বাউন্ডারি মেরে ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটার হিসেবে ৮ হাজার রান পূর্ণ করেন তামিম। তবে ২৬তম ওভারে তামিমকে থামিয়ে দেন জিম্বাবুয়ের স্পিনার সিকান্দার রাজা। শর্ট থার্ডম্যানে কাইয়াকে ক্যাচ দেন ৮৮ বলে ৬২ রান করা তামিম। তার ইনিংসে ৯টি চার ছিলো। লিটনের সাথে ১৫৪ বলে ১১৯ রান করেন তামিম। জিম্বাবুয়ের মাটিতে উদ্বোধনী জুটিতে এটিই সর্বোচ্চ রান। তামিমের ফেরার পর ২৯তম ওভারে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন লিটন। ৭৫ বলে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের সপ্তম অর্ধশতক করেন তিনি। হাফ সেঞ্চুরি পাওয়া ওভারে তিনটি চার মারেন লিটন। ৩৩তম ওভারে পরপর দুই বলে বাউন্ডারি ও ওভার বাউন্ডারি ছিলো লিটনের ব্যাটে। তবে ৩৪তম ওভারে দুভার্গ্যের শিকার হন লিটন। পায়ের পেশীতে টান পড়ায় স্ট্রেচার করে মাঠ ছাড়েন লিটন। ৯টি চার ও ১টি ছক্কায় ৮৯ বলে ৮১ রান করেন তিনি। তিন নম্বরে নামা আনামুল হকের সাথে ৪৫ বলে ৫২ রান যোগ করতে পেরেছিলেন লিটন।
এরপর আনামুলের সাথে ক্রিজে জুটি বাঁধেন অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম। রানের গতি বাড়াতে মারমুখী হয়ে উঠেন তিন বছর পর ওয়ানডে খেলতে নামা আনামুল। ৪১তম ওভারে লং-অন দিয়ে ছক্কা মেরে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৩৯তম ম্যাচে চতুর্থ হাফ সেঞ্চুরির দেখা পান তিনি। ২০১৪ সালের নভেম্বরে মিরপুরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন আনামুল। হাফ সেঞ্চুরির পর নিজের ইনিংস বড় করেছেন আনামুল। তার সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুত রান তুলেন মুশফিক। ৪৫তম ওভারে ব্যক্তিগত ৭২ রানে জীবন পান আনামুল। তবে পরের ওভারেই লং-অনে অভিষেক ম্যাচ খেলতে নামা ভিক্টোর নিয়ুচির বলে মুসাকান্দাকে ক্যাচ দেন আনামুল। ফলে ৬২ বলে গড়ে উঠা ইনিংসটি ৭৩ রানে থামে। ৬টি চার ও ৩টি ছক্কা মারেন তিনি। মুশফিক-আনামুল ৭৬ বলে ৯৬ রান তুলেছিলেন। সেখানে ৪০ বলে ৫৬ রান অবদান রাখেন আনামুল।
দলীয় ২৬৭ রানে আনামুলের বিদায়ে ক্রিজে মুশফিকের সঙ্গী হন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। তখন ইনিংসের ২৫ বল বাকী ছিলো। শেষ ২৫ বলে অবিচ্ছিন্ন ৩৬ রান তুলেন মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহ। ৫০ ওভারে ২ উইকেটে ৩০৩ রান তুলে বাংলাদেশ। মুশফিক ইনিংসের শেষ ওভারে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৪২তম হাফ সেঞ্চুরির স্বাদ নিতে ৪৭তম বল খেলেন। শেষ পর্যন্ত ৫টি চারে ৪৯ বলে অপরাজিত ৫২ রান করেন মুশফিক। ৩টি চারে ১২ বলে অপরাজিত ২০ রান করেন মাহমুদুল্লাহ। নিয়ুচি ও রাজা ১টি করে উইকেট নেন।
জয়ের জন্য ৩০৪ রানের টার্গেট পায় জিম্বাবুয়ে। জবাব দিতে নেমে মহাবিপদে পড়ে তারা। বাংলাদেশের দুই বাঁ-হাতি পেসারের তোপে ২ ওভারেই ২ উইকেট হারায় তারা। প্রথম ওভারের শেষ বলে জিম্বাবুয়ের চাকাবভাকে ২ রানে শিকার করেন মুস্তাফিজ। পরের ওভারে আরেক ওপেনার তারিসাই মুসাকান্দাকে ৪ রানে বিদায় দেন শরিফুল। শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেন ইনোসেন্ট কাইয়া ও ওয়েসলি মাধভেরে। ৬৮ বলে ৫৬ রানের জুটি গড়েছিলেন তারা। মাধভেরে রান আউট হলে জুটিতে ভাঙ্গন ধরে। ২৭ বলে ১৯ রান করেন মাধভেরে। ১৪তম ওভারে দলীয় ৬২ রানে তৃতীয় উইকেট পতনের পর জিম্বাবুয়ের হাল ধরেন কাইয়া ও রাজা। উইকেটে সেট হতে সময় নেননি তারা। ২১তম ওভারে দলের রান ১’শতে নেন কাইয়া ও রাজা। ৬৬ বলে হাফ সেঞ্চুরির স্বাদ নেন কাইয়া। ৩১তম ওভারের দ্বিতীয় বলে মুস্তাফিজকে ছক্কা মেরে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ২১তম হাফ সেঞ্চুরি তুলেন রাজা। ৩৩তম ওভারের প্রথম বলে শরিফুলের বলে থার্ড ম্যানে কাইয়ার ক্যাচ ফেলেন তাসকিন। আর ঐ ওভারের শেষ শরিফুল নিজেই কাইয়াকে দ্বিতীবারের মত জীবন দেন।
দু’বার জীবন পেয়ে ৩৯তম ওভারের ওয়ানডে ক্যারিয়ারের চতুর্থ ম্যাচেই প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পান কাইয়া। ঐ ওভারের শেষ বলে ১১৫তম ওয়ানডেতে চতুর্থ সেঞ্চুরি করেন রাজা। তাই কাইয়া ও রাজার জোড়া সেঞ্চুরিতে ম্যাচ জয়ের পথ পেয়ে যায় জিম্বাবুয়ে। শেষ ১০ ওভারে ৬২ রানের দরকার পড়ে জিম্বাবুয়ের। অবশেষে ৪২তম ওভারে কাইয়া-রাজা জুটি ভাঙ্গেন মোসাদ্দেক। শর্ট ফাইনে শরিফুলকে ক্যাচ দেন কাইয়া। ১১টি চার ও ২টি ছক্কায় ১২২ বলে ১১০ রান করেন কাইয়া। চতুর্থ উইকেটে ১৭২ বলে ১৯২ রানের ম্যাচজয়ী জুটি গড়েন তারা। বাংলাদেশের বিপক্ষে চতুর্থ উইকেটে এটিই সর্বোচ্চ রানের জুটি কাইয়া ও রাজার। কাইয়া যখন ফিরেন তখন ৪৯ বলে ৫০ রান দরকার ছিলো জিম্বাবুয়ের। বাকী কাজটুকু সাড়তে সাবধানে এগোতে থাকেন রাজা ও লুক জংওয়ে।
৪ ওভার বাকি থাকতে ২১ রান দরকার ছিলো জিম্বাবুয়ের। মুস্তাফিজের করা ৪৭তম ওভারের প্রথম বলেই ছক্কা মারেন জংওয়ে। দ্বিতীয় বলে লং-লেগে তাসকিনকে ক্যাচ দিয়ে জীবন পান জংওয়ে। তৃতীয় বলে চার মারলেও পরের ওভারের প্রথম মিরাজের শিকার হন তিনি। ১৯ বলে ২৪ রান করেন তিনি। এরপর দলের বাকী ৮ রানের প্রয়োজন মিটিয়েছেন রাজা ও শুম্বা। ৮টি চার ও ৬টি ছক্কায় ১০৯ বলে অপরাজিত ১৩৫ রান করে ম্যাচ সেরা হন রাজা। ১ রানে অপরাজিত ছিলেন শুম্বা। বল হাতে ১টি করে উইকেট নেন মুস্তাফিজ-শরিফুল-মিরাজ ও মোসাদ্দেক।
১০ বল বাকী রেখে ৩০৪ রানের টার্গেট স্পর্শ করে বাংলাদেশের বিপক্ষে রেকর্ডই গড়ে জিম্বাবুয়ে। বাংলাদেশের বিপক্ষে রান চেজ করে এর আগে ১৯৯৯ সালে ২৫৮ রানের টার্গেট স্পর্শ করার নজির আছে জিম্বাবুয়ের।
আগামী ৭ আগস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে আবারও মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে।
স্কোর কার্ড (টস : জিম্বাবুয়ে)
বাংলাদেশ :
তামিম ক কাইয়া ব রাজা ৬২
লিটন আহত অবসর ৮১
আনামুল ক মুসাকান্দা ব নিয়ুচি ৭৩
মুশফিকুর অপরাজিত ৫২
মাহমুদুল্লাহ অপরাজিত ২০
অতিরিক্ত (বা-১, লে বা-৭, ও-১৩) ১৫
মোট (২ উইকেট, ৫০ ওভার) ৩০৩
উইকেট পতন : ১/১১৯ (তামিম), ২/১৭১ (লিটন, আহত অবসর), ৩/২৬৭ (আনামুল)।
বোলিং : এনগারাভা : ১০-১-৬১-০ (ও-২), নিয়ুচি : ৯-১-৬৫-১ (ও-২), মাসাকাদজা : ৫-০-৩১-০ (ও-১), জংওয়ে: ১০-০-৫৬-০ (ও-২), বার্ল : ১.১-০-৮-০ (ও-২), শুম্বা : ৪.৫-০-২৭-০, রাজা : ৯-০-৪৮-১, মাধভেরে : ১-০-৫-০।
জিম্বাবুয়ে :
চাকাবভা বোল্ড ব মুস্তাফিজ ২
মুসাকান্দা ক মোসাদ্দেক ব শরিফুল ৪
কাইয়া ক শরিফুল ব মোসাদ্দেক ১১০
মাধভেরে রান আউট (তাইজুল/মিরাজ) ১৯
রাজা অপরাজিত ১৩৫
জংওয়ে ক আফিফ ব মিরাজ ২৪
শুম্বা অপরাজিত ১
অতিরিক্ত (বা-১, লে বা-২, ও-৯) ১২
মোট (৫ উইকেট, ৪৮.২ ওভার) ৩০৭
উইকেট পতন : ১/২ (চাকাবভা), ২/৬ (মুসাকান্দা), ৩/৬২ (মাধভেরে), ৪/২৫৪ (কাইয়া), ৫/২৯৬ (জঙ্গি)।
বোলিং : মুস্তাফিজুর : ৯-০-৫৭-১ (ও-২), শরিফুল : ৮.৪-০-৫৭-১ (ও-২), তাসকিন : ১০-১-৫২-০ (ও-৩), মিরাজ : ১০-০-৫৯-১, মোসাদ্দেক : ৯.২-০-৬৭-১ (ও-১), মাহমুদুল্লাহ : ১.২-০-১২-০ (ও-১)।
ফল : জিম্বাবুয়ে ৫ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচ সেরা : সিকান্দার রাজা (জিম্বাবুয়ে)।
সিরিজ : তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে জিম্বাবুয়ে।